পশ্চিমবঙ্গে 'সংরক্ষণের রাজনীতি'
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন পর্যন্ত তপশিলি জাতি ও জনজাতির ক্ষমতায়নের সঙ্গে ‘সংরক্ষণ রাজনীতির’ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ঔপনিবেশিক শাসনকালের শেষ পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গৃহিত ‘সংরক্ষণ ব্যবস্থা’ ভারত-বিভাজনের পরবর্তীকালে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে উঠে গেলেও ভারতে এই ব্যবস্থা এখনোও বিদ্যমান।
কিন্তু ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ‘সংরক্ষণের রাজনীতি’ ও ‘সংরক্ষিত আসনের রাজনীতি’ তপশিলি জাতি ও জনজাতিগুলোর রাজনৈতিক চেতনাকে রাজনৈতিক দাসত্বের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
১৯৩৬ সালে গৃহিত The Government of India (Scheduled Caste) Order বাংলায় মোট ৭৬টি সম্প্রদায়কে তপশিল ভুক্ত করেছিল। বাংলাদেশও সম্প্রতি ৫০টি সম্প্রদায়কে ‘দলিত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে ১০০টি সম্প্রদায় তপশিলি জাতি ও জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এঁদের সম্মিলিত জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০% (তপশিলি জাতি ২৪% ও তপশিলি জনজাতি ৫.৫%)। এই রাজ্যের বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে এঁদের জন্য মোট ৮৪টি (তপশিলি জাতি: ৬৮, ও তপশিলি জনজাতি:১৬) আসন সংরক্ষিত আছে।
কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) ও ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) মাত্র কয়েকটি সম্প্রদায়ের ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: রাজবংশী, নমঃশূদ্র, পৌণ্ড্র ও সাঁওতাল সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়গুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতির দিকে নজর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এঁদের জন্য তৈরি করেছে একাধিক উন্নয়ন পর্ষদ, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাষা একাডেমি। এমনকি এঁদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্বের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু তৃণমূল বা বিজেপি, কোন দলই অন্যান্য ৯৭টি সম্প্রদায়ের কথা একবারও উচ্চারণ করেনি।
স্বাভাবিকভাবেই ২০২১ সালের নির্বাচনে মাত্র ৮টি সম্প্রদায় একাধিক বিধায়ক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। এগুলো হল রাজবংশী, পৌন্ড্র, নমঃশূদ্র , বাগদি, শুঁড়ি, বাউড়ি, সাঁওতাল ও ওরাও । তবে তপশিলি সম্প্রদায় থেকে মাত্র ৬জন মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন (রাজবংশী: ১, পৌণ্ড্র: ১, নমঃশূদ্র: ১, সাঁওতাল: ২, চিকবড়াইক: ১)।
অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভোটার ও দৃশ্যমান বিধায়ক শ্রেণি প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক বা জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলের আজ্ঞা ও ঝান্ডাবাহকে পরিণত হয়েছেন। এটা রাজনৈতিক 'সংরক্ষণ ব্যবস্থা'র বাস্তবায়নের পদ্ধতির দিকেই আঙুল তুলছে।
লেখক: কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।