বোমার শব্দ থেকে শিশুদের রক্ষায় সুরেলা বাজনা

  • নুসরাত জাবীন বিভা, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার এক শিশু দালা

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার এক শিশু দালা

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাচ্চারা আনন্দ করছে, রঙিন বেলুন নিয়ে খেলছে, গানের সুরে মাথা দোলাচ্ছে— এটা বিশ্বের যেকোন প্রান্তের কোন এক স্কুল মাঠের দৃশ্য হতে পারে। তবে এই হাসিখুশি বাচ্চাদের কিচিরমিচির এক ক্ষণস্থায়ী বিভ্রম!

সিরিয়ায় নয় বছর ধরে চলা অমানবিক গৃহযুদ্ধের বোমা বিস্ফোরণের ভয়ানক শব্দ থেকে বাচ্চাদের কয়েক মুহূর্ত ভুলিয়ে রাখতে সুরেলা সঙ্গীতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজনা থামতেই আবার শোনা যায় মুহুর্মুহু গোলাগুলি ও বোমা বর্ষণের শব্দ। তারপর নেমে আসে বিষাদময় নীরবতা।

বিজ্ঞাপন

শিশু নিরাপত্তা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা হুররাস নেটওয়ার্কের বিলাল আল-শাওয়া বলেন, “আপনারা এদের চোখে ভয় দেখতে পাবেন। এদের বার বার খুঁজতে দেখবেন যে, কোন প্লেন আসছে কিনা।”

আল-শাওয়া সিএনএনকে বলেন, “বাচ্চাগুলোর খেলাধুলা এবং পড়াশোনার ব্যাপারে ভাবার কথা ছিল। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য কীভাবে তাদের ভীতিকর কিছু শোনা থেকে দূরে রাখা যায়।”

বিজ্ঞাপন
সিরিয়ার ইদলিবে বোমা হামলা

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বিরোধীদের সর্বশেষ ঘাঁটি ইদলিব প্রদেশের মারাত মিসরীন শহরের একটি স্কুলে হুররাস সুরেলা বাজনার এই আয়োজন করেছে। শিশুদের শারীরিকভাবে নিরাপদ রাখতে কারোই তেমন কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাই আল-শাওয়া ও তার প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে শিশুদের মানসিকভাবে যেন সুস্থ রাখা যায়।

সিরিয়ার যে জায়গাগুলো বিদ্রোহীদের বা তুরস্কের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে হুররাস সেখানে সাপ্তাহিক মানসিক-সামাজিক সহায়তা সেশনের আয়োজন করে। বাচ্চাদের সহনশীলতা এবং টিকে থাকার দক্ষতা তৈরি এবং প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে সাহস জোগানো এদের মূল উদ্দেশ্য। এই সংস্থা মা-বাবাদেরও সন্তানদের সাহস জোগানো এবং বাড়িতে ক্ষতির পরিমাণ কমানোর উপায় শিখতে সাহায্য করে।

গত ৫ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) প্রকাশিত এক জরিপে ইদলিবের শিশুদের ট্রমার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ মা-বাবা বলেছেন— তাদের সন্তানরা প্রায়ই অজানা কারণে অথবা সংঘর্ষ চলাকালে প্লেন উড়ে যাওয়ার সময় কেঁদে ওঠে। প্রায় ৪৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের সন্তানদের অস্বাভাবিকভাবে মন খারাপ করে থাকতে দেখা যায়। ৩০ শতাংশের বেশি বলেছেন, সন্তানরা অন্যদের প্রতি সহিংস হয়ে উঠছে এবং ২০ শতাংশের বেশি সেবাদানকারী বলেছেন, বাচ্চারা নিজেদের আলাদা করে রাখতে শুরু করেছে।

আট বছর বয়সী দালা; স্কুলের অন্য বাচ্চাদের মতো আর হাসে না, তার শূন্য দৃষ্টি। সে যেন এক দুঃসহ স্মৃতিতে আটকে আছে, যেখান থেকে বের হতে পারছে না। এক সপ্তাহ আগে রকেট হামলায় আহত দালা সেদিনের কথা মনে করে বলে, “আমি আর আমার বোন আপেল খাচ্ছিলাম, তখন রকেট এসে আমাদের আঘাত করে। ধুলা ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে আমি আমার ভাইবোনদের জন্য চিৎকার করছিলাম। মেঝেতে রক্ত দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”

দালার বাবা বলেন, “আমি অনেক দূরে পালিয়ে যেতে চাই, কিন্তু কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব? কীভাবে আমি এদের রক্ষা করব? একমাত্র আল্লাহই আমাদের রক্ষা করতে পারেন।”

বিদ্যালয়ের চত্বরে বোমার আঘাতের চিহ্ন

সেদিনের সেই রকেট হামলায় সাত শিশু মারা যায়! হয়তো দালার মুখেই ট্রমার ছাপ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে, তবে এখানকার সব শিশুই খুব ভালোভাবে জানে যুদ্ধ-মৃত্যু-ভয় কী বস্তু।

বোমারু বিমান এলে কী করতে হবে, প্রশ্ন করলেই সব বাচ্চারা একসাথে চিৎকার করে বলে ওঠে— ‘মাটিতে শুয়ে পড়ো’, ‘দৌড়ে বাঙ্কারে যাও’, ‘লুকিয়ে পড়ো’!

হুররাসের দলটি বাজনা বন্ধ করে ফিরে যেতে তৈরি হয়। শোনা গেছে কাছেই বোমারু বিমান চক্কর দিচ্ছে, ভিড় দেখলেই তারা টার্গেট করে। হোক না সে ভিড় ছোট্ট বাচ্চাদের।

বাচ্চারা স্কুলের মাঠ থেকে ফিরে যেতে থাকে আর তাদের কানে বাজতে থাকে যুদ্ধের দামামা!

সূত্র: সিএনএন