মহররম ও আশুরার দশ কাজ
বারো মাসের মধ্যে আল্লাহতায়ালা চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। এ প্রসেঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তন্মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ ও সম্মানিত। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ -সূরা তাওবা: ৩৬
নিষিদ্ধ চার মাস নির্ধারণ করে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই জামানা আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই তার আপন অবস্থায় ঘূর্ণায়মান। বছর হলো ১২ মাস। তন্মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ ও সম্মানিত। চার মাসের তিনটি হলো ধারাবাহিক তথা জিলকদ, জিলহজ, মহররম। আরেকটি হলো- জুমাদাল উখরা ও শাবানের মাঝখানে রজব।’ -সুনানে আবু দাউদ: ১৯৪৭
আল্লাহতায়ালার দেওয়া সম্মানিত মহররম মাস আমরা অতিক্রম করছি। সুতরাং এই মাসের সম্মান রক্ষায় আমাদের কিছু করণীয় ও বর্জনীয় আছে। তাই মহররম ও আশুরাকেন্দ্রিক করণীয় ও বর্জনীয় সর্ম্পকে আলোচনা করা হলো-
এক. অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে- আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ -সহিহ মুসলিম: ২৬৪৫
দুই. বিশেষভাবে আশুরা তথা মহররমের ১০ তারিখের রোজা রাখা। বাংলাদেশে রোববার (৩০ আগস্ট) পবিত্র আশুরা পালিত হবে। ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মহররম মিলিয়ে দু’টি রোজা রাখা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার একদিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে এই আশা করি যে, তিনি এ রোজার উসিলায় বান্দার আগের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ –সহিহ মুসলিম: ১১৬২
তিন. সব ধরনের গোনাহ বর্জন করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এই চার মাসের মধ্যে তোমরা (গোনাহ করে) নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ - সূরা তাওবা: ৩৬
চার. বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করা। এমনকি জিহাদের প্রয়োজন দেখা দিলে জিহাদের জন্যও ময়দানে ছুটে যাওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং তোমরা মুশরিকদের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে থাকে। জেনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।’ –সূরা তাওবা: ৩৬
পাঁচ. প্রচলিত মাতম মর্সিয়া পরিহার করা। প্রতিবছর আশুরা এলে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কারের মধ্যে অন্যতম একটি কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। তা হলো- মাতম মর্সিয়া গাওয়া। আর মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা এবং জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। নবী করিম (সা.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হায়-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ –সহিহ বোখারি: ১২৯৭
ছয়. জীবনের সবক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন থেকে বেঁচে থাকা। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং অন্যদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন তখন সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইহুদি এবং নাসারারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা মহররমের ৯ তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বলেন, এখনও আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করেন। -সহিহ মুসলিম: ২৫৫৬
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবী করিম (সা.) আমাদের অন্য জাতির সাদৃশ্য থেকে বাঁচতে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই প্রথমত আমাদের আশুরার রোজা একটির পরিবর্তে দু’টি রাখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনের সবক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন পরিহার করতে হবে।
সাত. আশুরার দিন বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহররম আল্লাহর মাস। এই মাসে এমন একটি দিন রয়েছে যেদিন তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ –তিরমিজি: ৭৪১
তাই ক্ষমা পাওয়ার আশায় এদিন বেশি বেশি ইস্তেগফার করা চাই।
আট. ‘আশুরার দিনের গুরুত্ব বোঝাতে মিথ্যা ও বানোয়াট জাল হাদিস বলা থেকে বিরত থাকা। কেননা হাদিসে মিথ্যা সংযোজনকারীকে জাহান্নামে ঠিকানা বানিয়ে নিতে বলা হয়েছে।’ –সহিহ বোখারি: ১০৭
নয়. আশুরাকেন্দ্রিক সমাজে প্রচলিত সব কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকা। কেননা, কুসংস্কারে বিশ্বাস করা ভীষণ পাপ ও ভ্রষ্টতার কারণ। আর আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ থাকে।’ -সূরা হিজর: ৫৬
দশ. আশুরাকেন্দ্রিক প্রচলিত ভুল বিশ্বাস থেকে বেঁচে থাকা। তন্মধ্যে একটি হলো- আশুরার দিন কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ধারণা। এটা ভুল। কেননা, এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো বিশুদ্ধ কোনো সনদে বর্ণিত হয়নি। সবগুলো বর্ণনা জাল সূত্রে বর্ণিত। তাই এ ধারণা পরিহার করা জরুরি।
আল্লাহতায়ালা সব মুসলমানকে ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বিশুদ্ধ দ্বীন মেনে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।