বেফাক মহাসচিবের পদত্যাগের ঘোষণা, নতুন দায়িত্বশীল নির্বাচন ৩ অক্টোবর
বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) ও পদাধিকার বলে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার প্রধান ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। আমৃত্য তিনি এই দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার তার মৃত্যুর পর কওমি সংশ্লিষ্টদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে কে আসবেন- তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
আল্লামা শফীর ইন্তেকালের আগে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী। তার পর ওই পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন পালন করছিলেন বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বেফাকের খাস কমিটির বৈঠকে তিনিও পদত্যাগের কথা জানান। সে হিসেবে বেফাককে সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মহাসচিব হিসেবে তিন জনকে নির্বাচিত করতে হবে।
মঙ্গলবার বেফাকের বৈঠকের খাস কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচন বিষয়ে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, ৩ অক্টোবর বেফাকের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫৭।
খাস কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মহাসচিব পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। এ কারণে ৩ অক্টোবর বেফাকের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক প্রধান তিনটি পদে নতুন মুখ নির্বাচিত করতে হচ্ছে। বেফাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবে এক দিনে গুরুত্বপূর্ণ তিন তিনটি পদে নেতা নির্বাচনের নজির নেই। এবারই প্রথম এমনটি ঘটতে যাচ্ছে। তাই এটা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা।
২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি মাওলানা নুরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরীর ইন্তেকালের পর একই বছর বেফাকের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আল্লঅমা শফী। তখন থেকে আমৃত্যু তিনি বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের সভাপতি হিসেবে ২০১৭ সালে সরকারি স্বীকৃত আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বেফাকের সভাপতি ও সিনিয়র সহ-সভাপতি যারা হবেন, তারাই হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান।
বেফাক ও হাইআতুল উলয়ার দায়িত্বশীলদের কথা বলে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাস ধরে বেফাকের মহাসচিব আবদুল কুদ্দুসের কিছু ফোনালাপকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ সমস্যা চলছে। এর প্রেক্ষিতে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ, পরীক্ষা অফিসের মাওলানা আবদুল গণী ও পরিদর্শক মাওলানা ত্বহাকে বহিষ্কার এবং একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার আগেই মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে দায়মুক্তি দিয়ে চিঠি দেন আল্লামা শফী। এটা নিয়ে জটিলতা বাড়লে আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়। নানা কারণে ওই কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। বিষয়টি নিয়ে ঢাকার আলেমরা উদ্বেগ প্রকাশ করে ১২ সেপ্টেম্বর কামরাঙ্গীর চর মাদরাসায় একটি ইসলাহী সমাবেশ করেন। সেখানে চার দফা দাবিতে একমত হন ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার অন্তত হাজারখানেক আলেম। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেফাকের মজলিসে শুরা ও আমেলার বৈঠক করে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান। ইসলাহী সমাবেশের ছয়দিনের মাথায় আল্লামা শফী ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন:
হেফাজত, খতমে নবুওয়ত ও বেফাকে পৃথক নেতৃত্ব!
হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে কারা আসছেন?
ঢাকার কয়েকজন আলেম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘আল্লামা শফীর জীবদ্দশায় বেফাক মহাসচিবের একসঙ্গে তিন পদ (মহাসচিব, সিনিয়র সহ-সভাপতি, কো-চেয়ারম্যান) দখল নিয়ে অনেকেই ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি আল্লামী শফী একান্ত লোক হিসেবে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেন। এমতাবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় তিনি চরম বেকায়দায় পড়েন। ফোনালাপের সূত্র ধরে কয়েকজনকে বহিষ্কার করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি সময়ক্ষেপন করার কৌশল অবলম্বন করেন। তবে হঠাৎ করে আল্লামা শফীর ইন্তেকালে তিনি অনেকটা আশ্রয়হীন হয়ে পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।’
২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর বেফাকের দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীর ইন্তেকালের পর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত পরে কাউন্সিলে মহাসচিব নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস।
বেফাকের নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি কিছুটা জটিল। এভাবে সামনের সারির নেতা নির্বাচনের ঘটনা আগে ঘটেনি। এবার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে নেতা নির্বাচন করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ধারণা, আপাতত ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল নির্বাচন করা হবে। পরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে বেফাকের সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মহাসচিব নির্বাচন করা হবে।’
বিগত কাউন্সিলে মজলিসে শুরা বিশেষ করে কার্যনির্বাহী কমিটিতে ব্যাপক আত্মীয়করণ, করোনাকালে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা, করোনার সময় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানো, মাদরাসা খোলা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারাসহ নানা বিষয়ে নিয়ে বেফাকের ভূমিকায় আলেম-উলামা ও মাদরাসার ছাত্ররা ক্ষুব্ধ। বলা চলে, বেফাক একটা স্থবির ও গতিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও বেফাকের গঠনতন্ত্র মোতাবেক, সভাপতি ও সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে সহ-সভাপতি প্যানেল থেকে ক্রমানুসের দায়িত্ব পালনের কথা। কিন্তু বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলীর ইন্তেকালের পর সেটা মানা হয়নি। তখন বলা হয়, এসব পদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারের মনোভাবকে গুরুত্ব দিতে হয়। সঙ্গত কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, এবারও সরকারের মনোভাব বেফাকের সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মহাসচিব নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
তবে বেফাকের একাধিক সহ-সভাপতি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘বেফাকের নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো চাপ নেই। এটা হলো, কাউকে কাউকে দমিয়ে রাখার কৌশল, বলতে পারেন এটা কৌশল বিশেষ। সাধারণ সদস্যদের সমর্থন আদায়ে এটা বেশ কার্যকর হয়, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উস্থাপন করা যায়।’
তার যুক্তি, ‘সরকার প্রভাব বিস্তার করলে, হাইআর সদস্য হিসেবে অনেকেই আসতে পারতেন না। কারণ হাইআর সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকজন রয়েছেন, যারা রাজনীতিতে সরাসরি সরকারবিরোধী জোটের পরিচিত মুখ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেফাকের এক সহ-সভাপতি ও খাস কমিটির সদস্য বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, ‘সভাপতি হওয়ার দৌঁড়ে বেফাকের বর্তমান সহ-সভাপতিদের মধ্যে বারিধারা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী ও যাত্রাবাড়ি মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সম্ভাবনা রয়েছে। আলোচনায় রয়েছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের পরিচিত মুখ, মাখজানুল উলুম মাদরাসা প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুর রাহমান হাফেজ্জীর নামও। তবে এখনও শেষ কথা বলার সময় হয়নি। প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। নতুন নতুন সমীকরণ হচ্ছে।’
তার মতে, ‘সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে বেফাকের বর্তমান সহ-সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী ও মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী বেশ এগিয়ে। অনেকে আবার মাওলানা সাজেদুর রহমান, মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদকেও এ পদে দেখতে চান।’
মহাসচিব হিসেবে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল বর্তমান সিনিয়র সহকারি মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক এগিয়ে। তবে, এ পদের দাবিদার আরও বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে মাওলানা নুরুল আমিনও রয়েছেন। তবে মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের পদত্যাগের ঘোষণা তাকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
বেফাকের গঠনতন্ত্রে সদর (সভাপতি) হওয়ার জন্য হওয়ার ৪টি শর্তের কথা বলা হয়েছে। এসব শর্তের অন্যতম হলো- ‘কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা বা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বা বহু সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত বা দায়িত্বশীল, এমন ধরনের ব্যক্তি অত্র প্রতিষ্ঠানের সদর হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।’
তদ্রুপ নাজেমে উমুমি (মহাসচিব) হওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- ‘কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা বা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বা বহু সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত এমন ধরনের ব্যক্তি অত্র প্রতিষ্ঠানের নাজেমে উমুমি (মহাসচিব) হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।’ আর মহাসচিবকে ‘সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ও অবকাশ থাকতে হবে। তবে সহকারী মহাসচিবের জন্য এই শর্ত অপরিহার্য নয়।’
অন্যদিকে, তরুণ আলেমরা বেফাকের নেতৃত্ব নির্বাচনে শতভাগ স্বচ্ছতা ও গঠনতন্ত্র অনুসরণের আহ্বান জানিয়ে নিজেদের মত সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে যেন কিছু না করা হয়। কেউ কেউ আবার দায়িত্বশীলদের বয়সসীমা নির্ধারণেরও দাবি তুলেছেন।