আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য দানশীলতার প্রয়োজনীয়তা
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখনই তাদের পালনকর্তার নির্দেশাবলির মধ্য থেকে কোনো নির্দেশ তাদের কাছে আসে, তখনই তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করো। তখন কাফেররা মুমিনদের বলে, ইচ্ছা করলেই আল্লাহ যাকে খাওয়াতে পারতেন, আমরা তাকে কেন খাওয়াব?’ - সূরা ইয়াসিন: ৪৬-৪৭
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ঈমানদাররা কোনো ওজর-আপত্তি না তুলে আল্লাহর নির্দেশমতো ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকেন। আর যাদের ঈমান নেই, তারা নানা ছলছুতায় ভালো কাজে ব্যয় করার বিষয় এড়িয়ে যেতে চায়।
‘দান করা’ বলতে আল্লাহতায়ালা নিছক দান-খয়রাত, সদকা-ফিতরার কথা বলেননি। ‘দান’ শব্দটার তাৎপর্য এখানে অনেক গভীর ও ব্যাপক। ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ জাকাত। সেটাও এই দানের অন্তর্ভুক্ত। ‘দান’ বলতে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লাহর রাস্তায় ‘দান’ বলতে যা বোঝায়, তার মধ্যে ঐচ্ছিক ও বাধ্যতামূলক উভয় ধরনের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। নিছক সওয়াবের প্রত্যাশায় দান-খয়রাত করা হলেই মুসলমানের দায়িত্ব প্রতিপালিত হয় না। সৎকাজে ব্যয় করতে হবে দায়িত্ব হিসেবে এবং মহান আল্লাহর নির্দেশের কথা মনে রেখে। জাকাতের মতো ফরজ ইবাদত পালন ছাড়াও, অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে দুস্থ-দরিদ্র মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে, সে জন্যও আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে।
কোরআনে কারিমে অপচয়কারীকে ‘শয়তানের ভাই’ বলা হয়েছে। ভালো কাজে ব্যয় করার মানে অপচয় নয়, সদ্ব্যবহার; তা সবার জানা। আল্লাহতায়ালা অপব্যয়ের মতো কার্পণ্যও পছন্দ করেন না। যিনি নিয়মিত জাকাত দেন, দান-খয়রাত করেন, ফেতরা-সদকা প্রদান করেন, স্বভাবে তার কৃপণ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মনে রাখতে হবে, শুধু ভালো কাজে ব্যয় করলেই হবে না। সতর্ক থাকা চাই যাতে আয়ের উৎসটাও হালাল হয়। অন্যায়ভাবে আয়ের ধারা বহাল রেখে কথিত ভালো কাজে তা ব্যয় করা হলেও গ্রহণযোগ্য নয়। সোজা কথা, আল্লাহর অনুমোদিত পন্থায় উপার্জিত অর্থ সম্পদই তার পথে ব্যয় করা।
সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত মহৎ উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত ছাড়া কাউকে প্রকৃত ধর্মপরায়ণ বলা যাবে না। দান করার বিষয়ে কোরআনে কারিমে এত বেশি তাগাদা দেওয়া হয়েছে যে, বিষয়টিকে ঈমানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বললে অত্যুক্তি হয় না। এ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘কোনোমতেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারো না, যে পর্যন্ত না তোমরা (মুক্তহস্তে) তা থেকে দান করো যা তোমরা ভালোবাসো। আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করে থাকো, আসলেই আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত।’ –সূরা আলে ইমরান: ৯২
একইভাবে আরও অনেক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, দানশীলতা আত্মাকে পরিশুদ্ধ অর্থাৎ অন্তঃকরণকে নির্মল ও পবিত্র করে তোলে। অতএব, আল্লাহর প্রতি তোমাদের দায়িত্ব পালন করে যাও যথাসাধ্য সর্বোত্তম উপায়ে এবং মনোযোগ দিয়ে শোনো, আর মান্য করো, আর ব্যয় করো; এটা তোমাদের আত্মার জন্য উত্তম। আর যে নিজের লোভ-লালসার কবল থেকে নিরাপদ থাকে, তারা সফলকাম। -সূরা তাগাবুন: ১৬
আমরা যখন দান-খয়রাত করে থাকি, তখন ধনসম্পদ লাভের আকাঙ্খা থাকে অবদমিত এবং সেইসঙ্গে পরকালের পুরস্কারকে আমরা দেই অগ্রাধিকার।
পার্থিব সম্পদ ও সম্পত্তির জন্য আসক্তির মাত্রা যত কমে, আমরা ততই বৈষয়িক উপায়-উপকরণের চেয়ে সৎকাজের ওপর জোর দেই বেশি। এই স্বল্পস্থায়ী পৃথিবী আর পরকালীন শাশ্বত জীবনের মাঝে সুন্দর ভারসাম্য অর্জনের ক্ষেত্রে এটা আমাদের সাহায্য করে। ‘যে এটাকে পবিত্র করেছে, সে হয়েছে সফলকাম।’ -সূরা আল শামস: ৯
আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদেরকে তার পথে ব্যয়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলছেন, ‘দেখো, তোমরা হচ্ছো তারাই, যাদের আহ্বান জানানো হয় আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য।’ -সূরা মুহাম্মদ: ৩৮
ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হলো তাবুকের যুদ্ধ। সাহাবিদের কেউ কেউ এ যুদ্ধে ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিচয় দিয়েছিলেন। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কারণে হয়েছিলেন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। অবশ্য কঠিন তওবা ও অনুশোচনার পর তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এ জন্য কৃতজ্ঞতাবশত তারা নিজেদের সম্পদ থেকে দান করতে চাইলেন। কিন্তু নবী করীম (সা.) তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহতায়ালা নবী করিম (সা.) কে বলেন, উল্লিখিত সাহাবিদের দান গ্রহণ করার জন্য, যাতে তাদের অন্তর পবিত্র হতে পারে। এ প্রসঙ্গে কোরআনের বাণী, ‘গ্রহণ করুন (হে মুহাম্মদ) তাদের সম্পদ থেকে জাকাত যার দ্বারা আপনি সেগুলো পরিশুদ্ধ করবেন, করতে পারেন সেগুলোকে বরকতময়; আর ওদের জন্য দোয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনাস্বরূপ। বস্তুত, আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। -সূরা তওবা: ১০৩
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ধনসম্পদ ও বিত্তবেসাত এ পার্থিব জীবনে মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। তাই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পরকালের পুরস্কারকে। সম্পদ ও সন্তান ইহজীবনের প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করে।’
আমরা যদি সম্পদ ভালো কাজে ব্যয় না করি, তা ইহলোক ও পরলোক- দু’জগতেই আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে পারে।
আল্লাহতায়ালা আরও বলছেন, শয়তান আমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এ অর্থে যে, আমরা যখনই দান-খয়রাতের কথা ভাবি, সাথে সাথেই এমন অনুভূতির সৃষ্টি হয়, ‘দান করলে ব্যাংক ব্যালান্স কমে যাবে এবং আমরা আর্থিকভাবে দুস্থ হয়ে পড়ব।’ এভাবে প্রকৃত অভাবী ব্যক্তিকেও সাহায্য করার পথে শয়তান আমাদের বাধা দেয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, এই আয়াতটি শয়তান তোমাদের ভয় দেখায় দারিদ্র্যের এবং অশ্লীল কাজ করতে প্ররোচনা দেয়। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করা এবং প্রাচুর্য দানের ওয়াদা করছেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সুবিজ্ঞ। -সূরা বাকারা: ২৬৮
আল্লাহতায়ালা আমাদের এই নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, এই দুনিয়ায় আমরা যা কিছু সৎকাজে ব্যয় করি না কেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্যয়কৃত সে অর্থসম্পদ পরকালে আমাদের মুক্তির উপায় এবং গোনাহের কাফফারা হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু করো, নিশ্চয়ই তিনি তা প্রত্যক্ষ করেন।’ -সূরা বাকারা: ১১০
আর আল্লাহতায়ালা শুধু যে একটি সৎকাজের জন্য শুধু একটি পুরস্কারই দেবেন, তা নয়। বরং তা আল্লাহর ইচ্ছায় কাজের সাতশ গুণ কিংবা আরও বেশি হতে পারে। সূরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত হলো (শস্যের) একটি বীজের মতো। এর থেকে বের হয় সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে থাকে একশ’টি শস্যদানা। আর আল্লাহ বাড়িয়ে দেন (তার পুরস্কার) যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ অতিদানশীল ও সর্বজ্ঞ।’
যারা আল্লাহর নির্দেশমতো সৎকাজে ব্যয় করে না, দেয় না জাকাত, পরকালে ওদের শাস্তির ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। সূরা তওবার ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা সোনা-রুপা জমিয়ে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের সংবাদ দিন (হে মুহাম্মদ) কষ্টকর ধ্বংসের।’
প্রসঙ্গক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতে হয়। তা হলো আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানুষকে তার প্রদত্ত একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর এটা দান করা হয় তাকে, যিনি নিজে আত্মাকে করেছেন পবিত্র পরিশুদ্ধ।
সূরা বাকারা ২৬৯ নম্বর আয়াতে এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহতায়ালা) যাকে ইচ্ছা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করে থাকেন এবং যার জন্য তা মঞ্জুর করা হয়, সে প্রকৃতপক্ষে এমন এক কল্যাণ লাভ করে যা উপচে পড়ছে, তবে যারা জ্ঞানবান তারা ব্যতীত কেউ এই বার্তার তাৎপর্য উপলব্ধি করবে না।’