পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসাও ইসলামের শিক্ষা

  • মুহাম্মদ হাসান মুরাদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এভাবে পাখি নিধন কাম্য নয়, ছবি: সংগৃহীত

এভাবে পাখি নিধন কাম্য নয়, ছবি: সংগৃহীত

এই পৃথিবী আল্লাহতায়ালার অপার দান। পৃথিবীতে রয়েছে নানা রঙ, অপূর্ব রূপ। উঁচু-নীচু পর্বত, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ। বিস্তীর্ণ বনভূমি আর শীতের কুয়াশা। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি, নদীর স্রোতধারা আর সাগরের ঢেউ। পাখিদের কলরব, জীব-জন্তুর অবাধ বিচরণ। এসব মিলেই আমাদের পৃথিবী।

বিশাল এই সৃষ্টি জগতে মানুষকে বলা হয়, আশরাফুল মাখলুকাত ও সৃষ্টির সেরা মানুষ। সৃষ্টিজগতের সব কিছুই মানুষের সেবায় নিয়জিত। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে কিছু দায়-দায়িত্ব।

বিজ্ঞাপন

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ –সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৪১

পৃথিবীতে জানা-অজানা নানা ধরনের জীব-জন্তু রয়েছে। এসবের প্রতি মায়া-মমতা পোষণ করতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।’ –সহিহ মসুলিম: ২৩১৮

বিজ্ঞাপন

হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একটি পিঁপড়া নবীকুলের কোনো এক নবীকে কামড় দিলে ওই নবী পিঁপড়ার বাসা জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। ফলে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। তখন আল্লাহতায়ালা এ মর্মে অহি পাঠালেন যে, একটি মাত্র পিঁপড়া তোমাকে কামড় দিলো, তাতে কি-না তুমি উম্মত ও সৃষ্টিকুলের এমন একটি সৃষ্টি দলকে জ্বালিয়ে দিলে যারা তাসবিহ পাঠ করছিল? –সহিহ মুসলিম: ৫৬৫৪

বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অযথা কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত।

কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত, ছবি: সংগৃহীত

আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, এক যৌনকর্মী প্রচণ্ড গরমে হেঁটে যাচ্ছিল। পথে একটি কুকুরকে দেখতে পেল- পিপাসায় কাতর হয়ে কূপের কাছে চক্কর দিচ্ছে। পিপাসায় তার জিহ্বা বের হয়ে গেছে। তখন সে তার চামড়ার মোজা দিয়ে কূপ থেকে কুকুরের জন্য পানি তুলে আনল এবং কুকুরকে পান করালো। ফলে আল্লাহতায়ালা তাকে মাফ করে দিলেন। -সহিহ মুসলিম: ৫৬৬৫

অবৈধ যৌনকর্ম নিকৃষ্টতম পাপ। কিন্তু একটি অসহায় প্রাণীর প্রতি সে দয়াপ্রবণ হয়েছে, তাই আল্লাহতায়ালা তার ওপর দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, এক স্ত্রীলোককে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়। কারণ সে বিড়ালটিকে বেঁধে রাখতো। নিজেও পানাহার করাতো না। আবার ছেড়েও দিতো না, যাতে সে জমিনের পোঁকা-মাকড় খেতে পারে। অবশেষে বিড়ালটি মারা গেল। -সহিহ মুসলিম: ৫৬৫৭

কী অবাক কথা! একজন অসতী নারী জীবের সেবা করে জান্নাত পেলো, আর একজন সতী নারী জীবে কষ্ট দিয়ে শাস্তিযোগ্য হলো।

হজরত কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ: ২৯

কারণ, গর্তে বিভিন্ন প্রজাতির পোঁকা-মাকড় বসবাস করে। পেশাব করলে তাদের বসতস্থান নষ্ট হবে, কষ্ট হবে। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন।

আরবদের কাছে নানা রকম উট ও গাধা থাকত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছেও সদকার উট আসতো। এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আরবরা লোহা গরম করে প্রাণীর মুখে দাগ লাগাতো। এতে পশুগুলোর কষ্ট হতো। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা গাধা কিংবা উটের মুখে দাগ লাগিও না। যদি লাগাতেই হয়, তবে নিতম্বের ওপর দাগ লাগাও। -সহিহ মুসলিম: ৫৩৭০

এটাও পশুর ওপর দরদের প্রমাণ বহন করে।

এভাবে ঝুলিয়ে পাখি বহন অমানবিক কাজ, ছবি: সংগৃহীত

প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর আসল নাম হলো- আবদুর রহমান ইবনে সখর। কিন্তু তিনি বিড়ালের বাচ্চা সঙ্গে রাখতেন। তাই তার নাম আবু হুরায়রা (বিড়ালের পিতা) হয়ে গেছে। প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এমন করতেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ৫টি প্রাণীর নামে সূরার নামকরণ করেছন। আবার ‘আনআম’ পশুসম্পদ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল করেছেন। এ সব কিছুই পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন।

পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির পশু-পাখি রয়েছে। জলে-স্থলে কিংবা উভচরে তারা বসবাস করে। এগুলোর সবই পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে এসব পশু-পাখির বিকল্প নেই।

পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। তাদের যত্ন নেওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। অনুগ্রহপ্রাপ্তির সোপান। সুতরাং আমরা কখনও নিজেদের আনন্দের জন্য তাদের কষ্ট দেবো না। অনেকেই খাঁচায় বিভিন্ন প্রকারের পাখি কিংবা পশু পালন করেন। এটা জায়েজ আছে। কিন্তু শর্ত হলো, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে, কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া যাবে না। এটা ইসলামে নিষেধ।

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপ্রতি ভবনে প্রবেশ করলেন, দেখলেন ভবনের চারপাশের বেষ্টনির ওপর কাঁচে টুকরা দেওয়া। তিনি সেগুলো অপসারণ করেছিলেন। কারণ, ভাঙা কাঁচের ওপর পাখি বসতে পারে না। পৃথিবীতে পাখি প্রেমের এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আবার এর বিপরীতও আছে। ২ জানুয়ারির পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ, ইতালিতে শতশত পাখি মরে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আঁতশবাজির কারণে পাখিগুলো মারা গেছে। এসব নির্মম দৃশ্য, পাপের কাজ।

আসুন, আমরা পশু-পাখিকে ভালোবাসি। সৃষ্টিজীবের প্রতি দয়া করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি দয়া করবেন। পশু-পাখির প্রতি সামান্য ভালোবাসা হতে পারে পরকালে আমাদের নাজাতের উসিলা।