মুমিনের বাসাবাড়ি যেমন হবে

  • মাওলানা আবদুল আলিম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

একজন মুমিনের ঘরে অবশ্যই শরিয়ত পালনের পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে

একজন মুমিনের ঘরে অবশ্যই শরিয়ত পালনের পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে

একজন মুমিনের বাসাবাড়িতে ইবাদত, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত থেকে শুরু করে ইবাদত-বন্দেগি পালনের আদর্শ-পরিবেশ থাকবে। কেননা, জিকির থেকে বিমুখ বাসাবাড়িকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আল্লাহর জিকির করে আর যে জিকির করে না, উভয়ের উদাহরণ মৃত ও জীবন্ত মানুষের মতো।’ -সহিহ বোখারি : ৬৪০৭

অর্থাৎ যারা আল্লাহর জিকির করে তারা জীবিত আর যারা আল্লাহর জিকির করে না তারা মৃতের মতো। কেননা যারা জীবিত তাদের সব কার্যকলাপ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্যই হয়, পক্ষান্তরে যারা মৃত তারা কোনো কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং জীবিত থেকেও আল্লাহর জিকির করেন না তারা মৃতের মতো।

বিজ্ঞাপন

পর্দা ও লজ্জাশীলতার পরিবেশ
একজন মুমিনের ঘরে অবশ্যই শরিয়ত পালনের পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। বিশেষভাবে নামাজ ও হিজাবের উপযোগী পরিবেশ থাকতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার স্মরণার্থে নামাজ কায়েম করো।’ -সুরা ত্বহা : ১৪

অনুরূপভাবে একজন মুমিনের ঘরে পর্দা ও লজ্জাশীলতার পরিবেশ থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ -সুরা আহজাব : ৫৯

বিজ্ঞাপন

হিজাব পালনের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- নারীরা যথাসম্ভব ঘরে থাকবে। বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে শরীর ও সৌন্দর্য জিলবাব দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখবে যাতে কোনোভাবেই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়।

বাড়িতে দ্বীনি তালিমের ব্যবস্থা
একজন মুমিনের বাড়িতে দ্বীনি তালিম তথা কোরআন–সুন্নাহ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা–মানহাজ, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সিরাতসহ অন্যান্য জরুরিয়াতে দ্বীনের শিক্ষাদানের পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। যেহেতু মানুষের প্রাথমিক শিক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ স্থান হলো ঘর। তাই পিতামাতা যাতে সন্তানদের এবং স্বামী যাতে স্ত্রীকে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে শেখায় এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, ইসলাম সেদিকে তাদের দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’ -সুরা তাহরিম : ৬

বর্ণিত আয়াতের অর্থ হজরত আলী (রা.) এভাবে করেছেন, ‘তোমরা নিজেরা শেখো এবং পরিবারবর্গকে শেখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতিনীতি এবং তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং এসব কাজে অভ্যস্ত করে তোল।’ -আল্লামা শাওকানি, ফাতহুল কাদির : ৫/২৪৬

মেহমানদের যত্ন করা
মানুষ থাকলে তার আত্মীয়-স্বজন থাকবে। বাড়িতে মেহমানও আসবে। তাই মেহমানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহে রাখা জরুরি। প্রকৃত মুমিনের বাড়িতে অবশ্যই মেহমানদারির ব্যবস্থা থাকবে। সেই সঙ্গে আরেকটা বিষয়ের প্রতি তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তার দ্বারা তার প্রতিবেশিরা যেন কষ্ট না পায়। কেননা, হজরত রাসুলুল্লাহ (সাল.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানের সম্মান করে। -সহিহ বোখারি : ৬০১৮

ঘর একটু বড় হওয়া
মুমিনের বসবাসের ঘর প্রশস্ত ও বড়োসড়ো হওয়া উচিত। তবে অবশ্যই তা সামর্থানুপাতে হবে। কারণ তাতে ইবাদতের জায়গা, হিজাবের সুব্যবস্থা ও মেহমানদারীর সুযোগ থাকতে হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সৌভাগ্যের বিষয় চারটি- সতীসাধ্বী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ি, সৎকর্মশীল প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন।’ -সহিহ আত তারগিব : ২/৬৮৮

ঘর নির্মাণে প্রতিযোগিতা ও অহংকার না করা
একজন মুমিন বাসাবাড়ি নির্মাণে অবশ্যই প্রতিযোগিতা ও অহংকার পরিহার করবে। বাড়িঘর, অট্টালিকা নির্মাণে প্রতিযোগিতা কাম্য নয়। হজরত জিবরাইল (আ.) কেয়ামতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দাসী তার আপন মুনিবকে প্রসব করবে, তুমি আরো দেখতে পাবে- নগ্নপদ বিবস্ত্র হতদরিদ্র মেষ রাখালেরা বড় বড় দালান-কোঠা নিয়ে গর্ব ও অহংকার করবে।’ -সহিহ মুসলিম : ৮

বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করা
মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো, বাড়িতে প্রবেশের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। কেননা, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে ও খাবার গ্রহণকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করলে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের রাত্রি যাপন ও রাতের আহারের কোনো ব্যবস্থা (এ ঘরে) হলো না; কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমরা রাত্রি যাপনের জায়গা পেয়ে গেলে। আহারের সময় আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমাদের রাতের আহার ও শয্যা গ্রহণের ব্যবস্থা হয়ে গেল।’ -সহিহ মুসলিম : ২০১৮

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর জিকির করে আর যে জিকির করে না, উভয়ের উদাহরণ মৃত ও জীবন্ত মানুষের মতো

 বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ বলা
একজন মুমিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ও ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। কেননা, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে, বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ’, তবে তাকে বলা হয়- তুমি হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছো, (আল্লাহতায়ালা) তোমার জন্য যথেষ্ট, তুমি হেফাজত অবলম্বন করেছো (অনিষ্ট থেকে)। তাতে শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। -সুনানে তিরমিজি : ৩৪২৬

ঘরে প্রবেশের সময় সালাম দেওয়া
একজন মুমিন ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেবে। কেননা, সালাম দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে যখন তোমরা কোনো ঘরে প্রবেশ করবে তখন তোমরা পরস্পরের প্রতি সালাম করবে অভিবাদনস্বরূপ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্ৰ।’ -সুরা আন নুর : ৬১

এই আয়াতের আলোকে, নিজ ঘরে অন্যের ঘরে প্রবেশের কিছু আদব বর্ণনা করা হয়েছে। তা হলো- ঘরে প্রবেশের সময় বাড়ির লোকদেরকে সালাম দেওয়া। মানুষ নিজের স্ত্রী-সন্তানদেরকে সালাম দেওয়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। কিন্তু ইমানদার ব্যক্তির জন্য জরুরি আল্লাহর আদেশ পালন করে সালাম দেওয়া। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের শান্তির দোয়া দেওয়া থেকে কেন বঞ্চিত রাখা হবে?

রাতে ও সন্ধ্যায় বাসায় এই বিষয়গুলো পালন করা
একজন মুমিন শয্যা গ্রহণের সময় দরজা বন্ধ করবে, আগুন (চুলা) নিভিয়ে নিবে ও খাবার পাত্র ঢেকে রাখবে। ঘুমানোর আগে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ জাতীয় কিছু কাজ করতে বলেছেন, প্রত্যেক পরিবারের জন্য তা মেনে চলা জরুরি। কেননা এতে বহু উপকারিতা রয়েছে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমাদের সন্তানদের ঘরে আটকে রাখো। কেননা এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু অংশ অতিক্রম করলে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পারো। আর ঘরের দরজা বন্ধ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। আর তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের মশকের মুখ বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের পাত্রগুলোকে ঢেকে রাখবে, কমপক্ষে পাত্রগুলোর ওপর কোনো বস্তু আড়াআড়ি করে রেখে দিয়ো। আর (শয্যা গ্রহণের সময়) তোমরা তোমাদের প্রদীপগুলো নিভিয়ে দেবে।’ -সহিহ বোখারি : ৫৬২৩