হালাল পণ্যে ‘এশিয়ার রাজা’ হতে চায় থাইল্যান্ড
বৌদ্ধধর্ম প্রধান দেশ থাইল্যান্ড সম্প্রতি মুসলিম বান্ধব হালাল খাবার ও পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়ার ফলে চার বছরের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
থ্যাইল্যান্ডের ওয়ানিচা আমখাম একজন মুসলিম, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংককের রাস্তায় রুটি বিক্রির একটি স্টল চালান। তার রুটির সঙ্গে কলা, চিজ, মুরগি থাকে এবং তিনি ইসলাম ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী হালাল খাবার গ্রাহকদের পরিবেশন করেন। এতে তার গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রচুর।
ওয়ানিচার প্রধান গ্রাহক হলেন ব্যাংককে কর্মরত মুসলিম কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী এবং পর্যটক। তবে সম্প্রতি তিনি দেখেছেন অনেকেই হালাল খাবারের নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেয় যা অন্যায়।
একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, একদিন তার পাশের একটি স্টলে ভাজা স্কুইড বিক্রি করা হচ্ছিল এবং সেখানে হালাল লেখা ছিল অথচ বিক্রেতা নিজে শূকরের মাংস খাচ্ছিলেন যা মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। তিনি বিক্রেতাকে প্রশ্ন করলে সে বলেন, এটা ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য।
দিন দিন বাড়ছে হালাল শিল্প
থাইল্যান্ড আশা করছে যে, তার ক্রমবর্ধমান হালাল শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় ইতিবাচক উন্নতি এবং কোভিড-১৯ মহামারি থেকে পুনরুদ্ধার এর জন্য সহায়ক হবে। থ্যাইল্যান্ড প্রধানত পর্যটন শিল্প নির্ভর দেশ। তবে বিশেষজ্ঞরা আশা করেন যে, থাইল্যান্ডের হালাল শিল্প সফল করতে হলে দেশটির মুসলিম দেশের দর্শনার্থীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। হালাল খাদ্যপণ্য এবং রাস্তার খাবারের সনদপত্রের অভাবে থাইল্যান্ডের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে, থাই সরকার একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের হালাল পণ্য প্রচার করতে এবং শিল্পের মান উন্নত এবং পরিকল্পনা প্রনয়ণে জোর দেয়। তাতে একটি ‘হালাল ভ্যালি’ তৈরির প্রস্তাব রয়েছে, যা থ্যাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে হতে পারে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ আআত পিসানওয়ানিচ বলেছেন, থাইল্যান্ডের সুনাম খাদ্য, পানীয় এবং কৃষির জন্য। তবে মালয়েশিয়া বহু আগেই মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বেশ আস্থা অর্জন করেছে কিন্ত থাইল্যান্ডের জন্য একই ধরনের আস্থা তৈরি করা কঠিন।
হালাল সনদপত্র এবং রপ্তানিতে সাফল্য
বর্তমানে থাইল্যান্ডে প্রায় ১৫ হাজার কোম্পানি, ১ লাখ ৬৬ হাজার পণ্য এবং ৩ হাজার ৫০০ রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেগুলো হালাল সনদপ্রাপ্ত। মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার পরে, থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম হালাল পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে, থাইল্যান্ড প্রায় ৪.১ বিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্য, যেমন চিনি, চাল এবং ফ্রোজেন মুরগির মাংস, মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে রপ্তানি করেছে। থাইল্যান্ডের প্রায় ৯৩ শতাংশ জনসংখ্যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও, দেশটি হালাল পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সুযোগ বাড়ছে।
অন্যান্য অমুসলিম দেশ যেমন ব্রাজিল, চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রও হালাল পণ্যের প্রধান রপ্তানিকারক এবং ওআইসিভুক্ত দেশগুলোতে ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানি করে। ওআইসি রিপোর্ট পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০৬০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মুসলিম জনসংখ্যা তিন বিলিয়ন হবে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ।
রাস্তার খাবারের বিক্রেতাদের চ্যালেঞ্জ
থাই মুসলিম ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ফুয়াদ গুনসুন বলেছেন, থাইল্যান্ড ইতিমধ্যে হালাল পণ্যের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী দেশ। তবে রাস্তার খাবারের বিক্রেতারা প্রায়ই হালাল সনদপ্রাপ্তি সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখেন না, যা মুসলিম পর্যটকদের কাছে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মাস্টারকার্ড-ক্রেসেন্টরেটিং গ্লোবাল মুসলিম ট্র্যাভেল ইনডেক্স অনুযায়ী, থাইল্যান্ড অমুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় মুসলিম-বান্ধব গন্তব্যের মধ্যে অন্যতম। এটি সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান এবং হংকংয়ের পরে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড মুসলিম পর্যটকদের জন্য হালাল খাবার সরবরাহ সহজলভ্য করছে।
- বিশ্বজুড়ে হালাল বিনিয়োগ কেন বাড়ছে?
- বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছে হালাল ট্যুরিজম
- হালাল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে
- হালাল পর্যটন বাড়ানোর উদ্যোগ থাইল্যান্ডের
- অমুসলিমরাও হালাল খাদ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে
যেমন ব্যাংককের প্রসিদ্ধ পাইকারি বাজার প্রাতুনামে, যেসব ব্যবসায়ী হালাল খাবার বিক্রি করে না, তাদের গ্রাহক সংখ্যা অর্ধেক। তবে ফুয়াদ গুনসুন সতর্ক করে বলেছেন, হালাল বলে ক্রেতাকে ভুল খাবার দেয়া ঠিক নয়; কারণ থাইল্যান্ড যখন শীর্ষ পর্যটন শিল্প হতে চায়।
হালাল মান উন্নত করার প্রচেষ্টা
কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যে হালাল মান মেনে চলার চেষ্টা করছে। সাহা ফার্মস একটি মুরগি রপ্তানিকারক কোম্পানি, হালাল সনদপ্রাপ্ত এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করেছে। সাহা ফার্মসের বিদেশি বিক্রয় ও বিপণনের প্রেসিডেন্ট জারুয়ান চোটিতাওয়ান বলেছেন, কোম্পানিটি মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দ্বারা তাদের পণ্য পরীক্ষিত হয়েছে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি তার হালাল ব্র্যান্ডিং আরও শক্তিশালী ও উন্নয়ন করতে চায়।
থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ইসলামিক কাউন্সিল পরিচালিত Halal.co.th নামক ওয়েবসাইটে হাজার হাজার হালাল সনদপ্রাপ্ত পণ্য তালিকাভুক্ত রয়েছে। যেমন স্ন্যাকস, পানীয় এবং অন্যান্য সামগ্রী। গুনসুন উল্লেখ করেছেন যে, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার কাছ থেকে হালাল প্রসাধনী এবং পোশাকের মতো পণ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে। তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া হালাল ব্যবসায়িক ব্যবস্থা থেকে থাইল্যান্ড অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
আআত পিসানওয়ানিচ বলেন, যে হালাল সনদপত্র পাওয়া যদিও একটু ব্যয়বহুল। যেমন ব্যাংককে একটি সনদের ফি ১০ হাজার বাথ থেকে শুরু এবং পর্যায়ক্রমে ফি বাড়ে। তবে হালাল খাবার দাবি করে মিথ্যা বললে ব্যাংককের আইনে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়। থাইল্যান্ড মুসলিম পর্যটকদের আস্থা অর্জন এবং হালাল কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।