আল আকসা যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ
যে নামেই ডাকা হোক হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র নগরীর মর্যাদা জেরুজালেম। ছোট্ট একটি শহরকে ঘিরে তিন ধর্মের মানুষের এমন আবেগ, স্মৃতি বা ঐতিহ্য নেই পৃথিবীর আর কোথাও। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর শহর জেরুজালেম।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা, ‘ওল্ড সিটি’ খ্যাত শহরটি বিভক্ত মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও আর্মেনীয় বসতিতে। এখানে রয়েছে এসব ধর্মের অনেক পবিত্র স্থাপনা। তাই এই নগরীর পবিত্রতা নিয়ে মতভেদ না থাকলেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। আছে দফায় দফায় দখল, পুনর্দখল, ধ্বংস আর পুনর্নির্মাণের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস।
সবচেয়ে বেশি টানাপোড়েন পবিত্র ভূমিকে ঘিরে। চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের কেন্দ্র এ এলাকায় অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ আল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাসসহ মুসলিমদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
মুসলমানদের প্রথম কেবল আল আকসা। মেরাজ রজনিতে এখান থেকেই ঊর্ধ্বাকাশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
একই জায়গায় অবস্থিত ইহুদিদের পবিত্র ভূমিখ্যাত ‘টেম্পল মাউন্ট’ বা ‘ঈশ্বরের ঘর’। যা ‘কুব্বাত আস সাখরা’ নামে হিসেবে পরিচিত। টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত।
এখানে নিয়মিত প্রার্থনায় অংশ নেয় লাখো ইহুদি। যিশু খ্রিস্টের স্মৃতিবিজড়িত গির্জার কারণে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পবিত্রতার দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, এখানেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল যিশুকে।
১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরের সঙ্গে কত ইতিহাস, কত স্মৃতি জড়িত তার ইয়ত্তা নেই। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি- এ তিন ধর্মের মানুষের কাছেই হাজার বছর ধরে সমান গুরুত্ব জেরুজালেমের।
ইতিহাসসমৃদ্ধ জেরুজালেম স্বাভাবিকভাবেই আজও সমান আলোড়ন তোলে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের হৃদয়ে। পৃথিবীর অন্যতম পুরনো শহরকে নিয়ে টানাপোড়েনও হাজার বছরের, ধর্মীয় যুদ্ধে বারবার যার হাতবদল হয়েছে। কিন্তু নিজেদের অধিকার ছাড়েনি কোনো পক্ষই। যুগে যুগে অসংখ্য ঘটনার ও সহিংসতার সাক্ষী হওয়া পুরো নগরীকে নিজেদের রাজধানী দাবি করে ইসরায়েল। কিন্তু চাইলেই কী আর সম্ভব? অবশ্যই না। জেরুজালেম প্রশ্নে একমাত্র ইসরায়েল ছাড়া পুরো বিশ্ব মুসলমানদের দাবীর সঙ্গে একমত।
প্রশ্ন হলো- আল আকসা এত গুরুত্বপূর্ণ কেনো? এর উত্তর খুঁজেছে আল জাজিরা। সেখানে বলা হয়েছে-
আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সটি ৩৫ একর জমির ওপর নির্মিত। এটি মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) থেকে আসা তিনটি ধর্মের কাছেই এই মসজিদ অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যাকাসহ পুরোনো শহর পূর্ব জেরুজালেম দখল করার পর পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ একখণ্ড জমি হচ্ছে এই মসজিদ কমপ্লেক্স। যদিও ইসরায়েল সৃষ্টির বহু আগ থেকেই জেরুজালেম নিয়ে সঙ্ঘাত চলছে।
ব্রিটিশের দখলে থাকার সময় ১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিক ভূখণ্ড ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করে জাতিসঙ্ঘ। এর একাংশে প্রধানত ইউরোপ থেকে আমদানি করা ইহুদিদের দেওয়া হয় এবং অন্য ছোট অংশ সেখানকার আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের দেওয়া হয়। ইসরায়েলকে দেওয়া হয় ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশ এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভাগে রাখা হয় ৪৫ শতাংশ।
আর আল আকসা মসজিদের নগরী জেরুজালেমকে জাতিসঙ্ঘের প্রশাসনাধীনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য রাখা হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর বংশধরদের তিনটি ধর্মের মানুষের জন্য এ নগরীকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ এলাকা দখল করে নেয়। পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজার বাকি এলাকা মিসর ও জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল তার দখল আরও সম্প্রসারিত করে। ইসরায়েল এ যুদ্ধে আল আকসা মসজিদ ও ওল্ড সিটিসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল ও পরে একীভূত করে নেয়। যদিও ওল্ড সিটিসহ পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলের অবৈধ দখল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
জেরুজালেমের মালিকানা এবং ভৌগোলিক ও জনসংখ্যা তাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তনে ইসরায়েলের অপচেষ্টাকে বিশ্বের কোনো দেশ এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। প্রায় চার লাখ ফিলিস্তিনির জেরুজালেমে স্থায়ী বসবাসের মর্যাদা রয়েছে তারা সেখানে জন্ম নিলেও তাদের নাগরিকত্ব নেই। অথচ ইহুদিদের ক্ষেত্রে এর উল্টো নিয়ম।
১৯৬৭ সাল থেকে নানা শর্ত ও অজুহাতজুড়ে দিয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেম ছাড়া করে। ইসরায়েল নগরীতে ১২টি সুরক্ষিত ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। তাতে ২ লাখ ইহুদি বসবাস করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর নির্মাণের কোনো অনুমতি দেয় না এবং অবৈধভাবে তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করছে।
১৯৬৭ সালে জর্ডান ও ইসরায়েল এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরের সব কিছু দেখভাল করবে ওয়াকফ বা ইসলামি ট্রাস্ট। আর ইসরায়েল এটির বাইরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। অমুসলিমরা শুধু পরিদর্শনে যেতে পারবেন। তবে সেখানে প্রার্থনা করতে পারবেন না। প্রার্থনা করার অনুমতি কেবল মুসলিমদের।
আল আকসা ফিলিস্তিনের ছোট্ট একটি অংশ, কিন্তু এটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধের প্রতীক। মসজিদ মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র স্থান এবং বিশেষ করে আল আকসা। এমনকি আল আকসার পবিত্রতা ক্ষুন্ন করার ইহুদি তৎপরতার বিরুদ্ধে সেখানকার খ্রিস্টানরাও প্রতিবাদ জানায়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই স্থাপনার মর্যাদা ক্ষুন্ন করার চেষ্টাকে মুসলিমরা তাদের প্রতি ইসরায়েল সরকারের অব্যাহত অবিচার ও নিপীড়নের প্রতীক বলে বিবেচনা করেন।