বসনিয়ার সিনান বে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করল তুরস্ক

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বসনিয়া হার্জেগোভিনায়ার ক্যাজনিসে অবস্থিত সিনান বে মসজিদ, ছবি: সংগৃহীত

বসনিয়া হার্জেগোভিনায়ার ক্যাজনিসে অবস্থিত সিনান বে মসজিদ, ছবি: সংগৃহীত

ভয়াবহ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বসনিয়া হার্জেগোভিনায়ার ক্যাজনিসে অবস্থিত সিনান বে মসজিদটি সফলভাবে পুনর্নির্মাণ করেছে তুরস্কের সরকারি দাতা সংস্থা। পুনর্নির্মাণের ফলে শুধুমাত্র মসজিদটির সৌন্দর্য নয়, বরং এর প্রকৃত নকশাও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি এখানে থাকা সিনান বে ও তার স্ত্রীর সমাধিও সংস্কার করা হয়েছে। জানা গেছে আগামী শুক্রবার মসজিদটি উদ্বোধন করা হবে।

সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মুসলিম কমিউনিটি এবং তুরস্কের সরকারি দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে।

বিজ্ঞাপন

মসজিদটি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণ করেন তৎকালীন উসমানীয়দের প্রধান ও বিখ্যাত নির্মাণ শিল্পী সিনান বে। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ৮ জুন যুদ্ধ চলাকালে সার্বিয়ান সেনারা এটিকে ধ্বংস করে দেয়।

গোরাজদের মুফতি রেমজি পিতিক মসজিদটি সফলভাবে পুনর্নির্মাণের সকল কাজ শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরের মধ্যে গোরাজদে অঞ্চলে নির্মিত এটি তৃতীয় মসজিদ। আমাদের আরো অনেক কিছু করার রয়েছে। মসজিদটির পুনর্নির্মাণ ক্যাজনিসের বাসিন্দাদের জন্য একটি নতুন জীবনের সূচনা করবে। মসজিদটির জন্য এই অঞ্চলে সফর করার প্রেরণা পাবে অনেক মানুষ।’

বিজ্ঞাপন

বলকান রাষ্ট্র বসনিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘বসনিয়া অ্যান্ড হারজেগোভিনা।’ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের দুটি পৃথক অঞ্চল বসনিয়া ও হারজেগোভিনা নিয়ে তা গঠিত। মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়া একইসঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত। এর পূর্বে সার্বিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মন্টিনেগ্রো, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্রোশিয়া অবস্থিত।

দেশটি ৩ মার্চ ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বসনিয়ার মোট আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের মতো। জনসংখ্যার ৫০.৭ শতাংশ মুসলিম।

১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় সুলতানের হাতে ‘কিংডম অব বসনিয়া’র পতন হলে এ অঞ্চলে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। তবে ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত যে, বসনিয়ায় জোরপূর্বক ও গণধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেনি; বরং বসনিয়ায় মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়েছে কয়েক শতাব্দীর মুসলিম প্রচেষ্টার ফলে।

দেশটির মুসলমানদের বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় শাসকরা বসনিয়াকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলে বসনিয়ান মুসলিমদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। এ সময় বহু মুসলিম তুর্কি শাসিত অঞ্চলে হিজরত করেন। তবে বেশির ভাগ বসনিয়ান মুসলিম নিজ দেশে থেকে যান। অবশ্য অস্ট্রিয়ান শাসকরাও চাচ্ছিলেন বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় দেশত্যাগ না করে এবং ইস্তাম্বুলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করুক। ফলে ১৮৮২ সালেই তারা বসনিয়ায় ‘রইসুল উলামা’ নিয়োগ দেন এবং পাঁচ বছর পর ‘শরিয়া আইন’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বসনিয়ান মুসলিমদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালে শাসকরা ‘ওয়াকফ’ ও ইসলামি শিক্ষা পরিচালনায় স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বসনিয়াকে কমিউনিস্ট শাসিত যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে একীভূত করা হলে মুসলিমদের দুঃসময় শুরু হয়। কমিউনিস্ট শাসকরা সব ধরনের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করে। মুসলিমরা আরও বিপন্ন হয়ে ওঠে, যখন ১৯৯০-এর দশকে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় ক্ষমতাসীন সার্বদের গণহত্যার শিকার হয় বসনিয়ান মুসলিমরা।

মুসলিম নিধনের জন্য সার্বপ্রধান গ্রামগুলোতে অসংখ্য নির্যাতন শিবির গড়ে ওঠে। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ৫০ হাজারের মতো বসনিয়ান নারী গণধর্ষণের শিকার হন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বসনিয়ায় মুসলিম নিধনকে ‘গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল প্রচেষ্টা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুদ্ধের সময় সহস্রাধিক মসজিদসহ প্রায় চার হাজার মুসলিম স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। মুসলমানদের মসজিদ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খানকা ও সমাধিসৌধের প্রায় ৮০ শতাংশ এই সময় ধ্বংস করা হয়।

বসনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও সব ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করে থাকে এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখে। ‘দ্য ইসলামিক কমিউনিটি ইন বসনিয়া অ্যান্ড হারজেগোভিনা’ বসনিয়ার রাষ্ট্র স্বীকৃত মুসলিম প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান। উসমানীয় শাসনামল থেকে সংস্থাটি মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করে। এ ছাড়া দেশটির প্রধান আট শহরে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত আটজন মুফতি আছেন। যারা মুসলিমদের স্থানীয় সমস্যাগুলো সমাধান করেন।