সর্বনাশা আত্মপ্রচারে ঈমান-আমল ধ্বংস হয়

  • মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের কাজে-কর্মে লোক দেখানো মনোভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে চলছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়, ছবি: সংগৃহীত

আমাদের কাজে-কর্মে লোক দেখানো মনোভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে চলছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়, ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহতায়ালা ছাড়া অন্য কাউকে দেখানোর জন্য বা কারও কাছ থেকে প্রশংসা, সম্মান কিংবা পুরস্কার লাভের জন্য কাজ করাকে ‘রিয়া’ বলা হয়। বাংলায় আমরা একে আত্মপ্রচার, প্রদর্শননেশা ও প্রদর্শনিচ্ছা বলতে পারি। পবিত্র কোরআন-হাদিসে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রিয়াকে ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমান সময়ে আমাদের কাজে-কর্মে লোক দেখানো মনোভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে চলছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শুধু খাবার-দাবার নয়, স্মার্টফোনের ‘কল্যাণে’ ইবাদত-বন্দেগি, আমল-আখলাক, হজ-উমরা, দান-উপহার, দ্বীনী মেহনত, কোনো অনুষ্ঠানে কিছু বলা বা তাতে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় কাজকে আমরা আত্মপ্রচারের বাহন বানিয়ে ফেলছি।

বিজ্ঞাপন

হজে বা উমরায় যাচ্ছি, তো প্রথমে ইহরাম পরেই নিজের ছবি পোস্ট করে দিচ্ছি। মিনা আরাফাতের ছবি পোস্ট করছি। এমনকি বায়তুল্লাহ ধরে বা তার সামনে দাঁড়িয়ে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এবং পোস্ট করছি। আহ! এত হতভাগা হলাম, যে বায়তুল্লাহ সব শিরকের মূলোৎপাটনকারী ও তাওহিদ-ইখলাসের নিদর্শন, যাকে আল্লাহতায়ালা ‘আমার ঘর’ বলেছেন, সেটাকে আমি নিজের প্রচারের জন্য ব্যবহার করছি!

এত বড় দুঃসাহস আমার যে, নবী কারিম (সা.)-এর রওজার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এবং নবীর রওজাকে আত্মপ্রচারের জন্য ব্যবহার করছি! ইহরাম এত পবিত্র ও মহিমান্বিত, যা দিয়ে আমার পাপমোচন করে আমি নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হব, সেটাকেও আত্মপ্রচারের জন্য ব্যবহার করছি!

বিজ্ঞাপন

দ্বীনী বা দুনিয়াবী বড় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বসলাম, সঙ্গে বসার একটি ছবিও তুলে নিলাম, এরপর তা পোস্ট করছি।

এক ভাই একজনের একটি পোস্ট দেখাল। একজন আরেকজনকে একটি কিতাব হাদিয়া দিয়েছেন। হাদিয়া বাক্য লিখতে গিয়ে প্রাপকের নামের শুরুতে কিছু শ্রদ্ধা বাক্য লিখে প্রাপকের নাম লেখেন। প্রাপক লেখাটির ছবিসহ তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে। সঙ্গে এটাও লিখে দেন যে, ‘হাদিয়াদাতা অধমের নামের শুরুতে কিছু লকব লাগিয়ে দেন। অধম এগুলোর যোগ্য নয়। আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের জন্য কবুল করুন।’ লকবের যোগ্য হই বা না হই, লেখাটির ছবি তুলে পোস্ট করার কী প্রয়োজন? সঙ্গে আবার নিজের বিনয় বাক্যও জুড়ে দিলাম! এভাবে যে আরো কতভাবে আমরা আত্মপ্রচার করছি তার হিসেব নেই।

এটা জরুরি নয় যে, এসব ক্ষেত্রে সবারই আত্মপ্রচারের নিয়ত থাকে। কেউ হয়তো কোনো মাকসাদ ছাড়াই শুধু রেওয়াজের তালে করে। কারও হয়তো শুধু বিষয়টার ব্যাপারে নিজের লোকদের অবগত করা উদ্দেশ্য থাকে। যদিও পদ্ধতি ভুল অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এটা তো হলো- অন্যের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, যা উচিত বটে। আমার বলার উদ্দেশ্য, আমরা প্রত্যেকে কি আত্মসমালোচনা করব না, নিজ নিয়তের যাচাই করব না? নিজের সন্দেহযুক্ত কাজগুলোর ভালো ব্যাখ্যা দাঁড় না করিয়ে তার মধ্যে কী খারাবি লুকিয়ে থাকতে পারে, সেদিকে নজর রাখাই তো মুমিনের কাজ।

যেসব লোক দুনিয়াবী বিষয় দিয়ে আত্মপ্রচার ও প্রসিদ্ধির নেশায় মত্ত; ফলোয়ার, ভিওয়ার বাড়ানোই নিজের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য, তারা তো ধোঁকার মধ্যেই আছে- জানা কথা। কিন্তু আমরা তো দ্বীন, ঈমান, আখেরাত বুঝি, আখেরাতকে আমাদের মাকসাদ বলি এবং সে হিসেবে দ্বীন ঈমান পালনে ব্রত হই। কিন্তু দ্বীন পালন করতে গিয়ে দ্বীন-আমল দিয়ে ফেমাস-প্রসিদ্ধি কামাই- এটা যে আমার জন্য বরবাদির কারণ- সেটি আমার বুঝে আসে না কেন?

আত্মপ্রচার যে কত ভয়ংকর, ধ্বংসাত্মক- আমরা এর অনুভূতিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। বরং আত্মপ্রচার আজ আমাদের কাছে এত মোহনীয় ও চাকচিক্যময় হয়ে উঠেছে যে, এটি প্রায় সবার নিকট ‘ফ্যাশন’-এ পরিণত হয়েছে। এটির মধ্যে যে খারাবি আছে- তাও আমাদের অনেকের বোধগম্য নয়। তাই যে যা দিয়ে আত্মপ্রচারের সুযোগ পাই, নির্দ্বিধায়, বরং মনের লোভ, স্বাদ ও আনন্দ নিয়ে প্রচার করছি। অথচ আত্মপ্রচার ভয়ংকর গুনাহ ও মারাত্মক ধোঁকা।

আল্লাহতায়ালা ও তার রাসুল আত্মপ্রচারকে শিরক বলেছেন। আত্মপ্রচার যে কত ভয়ংকর গুনাহ তা বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ঠ যে, তা আল্লাহর জন্য না করে আত্মপ্রচারের জন্য করা, অথবা আল্লাহর জন্য করল, সঙ্গে আত্মপ্রচারও থাকল, তাহলে আত্মপ্রচারকে আল্লাহর সমকক্ষ ও শরিক বানিয়ে নিল।

ইবাদত-বন্দেগি হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহতায়ালা সুরা কাহাফের শেষে বলেন, ‘সুতরাং যে কেউ নিজ রবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ রবের ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে।’ -সুরা কাহাফ : ১১০

‘রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করা’র কথা বললে তো সবার সামনে এ অর্থ ভেসে ওঠে যে, আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরিক না করা। এ অর্থ তো আপন স্থানে ঠিক আছে। কিন্তু ইসলামি স্কলাররা কোরআন-হাদিসের আলোকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আরও একটি শিরকের কথা বলেন। তারা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রিয়ার (লোক দেখানো) কথা বলেন। ইমাম তাবারি (রহ.) বলেন, ‘অর্থাৎ সে যেন তার ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করে। আর শরিককারী তখনই হবে, যখন সে বাহ্যত দেখাবে যে, আমল সে একমাত্র আল্লাহর জন্য করছে, অথচ তার নিয়ত ভিন্ন।’ -তাফসিরে তাবারি : ১৫/৪৪০

নবী কারিম (সা.) আমাদেরকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়েছেন এভাবে, ‘যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য রোজা রাখে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য সদকা করে, সে শিরক করল।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৭১৪০