দখলদার ইহুদিবাদী ইসরায়েল অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে গত এক বছরের ভয়াবহ গণহত্যার সময় প্রায় এক হাজার মসজিদ ধ্বংস করেছে বলে গাজার ওয়াকফ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৮১৪টি মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং ১৪৮টি মসজিদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মসজিদের পাশাপাশি দখলদার সেনারা তিনটি গির্জা এবং ১৯টি গোরস্থান ধ্বংস করেছে বলেও মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজার ওয়াকফ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ৩৫ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলি সৈন্যরা কবরস্থানগুলোর পবিত্রতা নষ্ট করেছে, তারা কবর থেকে বহু মৃতদেহ উত্তোলন করেছে এবং মৃত ব্যক্তিদের দেহের ওপর বর্বর নৃশংসতা চালিয়েছে।
এদিকে শনিবার (৫ অক্টোবর) অবরুদ্ধ গাজার এক মসজিদে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ১৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো মসজিদে বোমাবর্ষণ করেছে, দেইর এল বালার আল আকসা শহীদ হাসপাতালের কাছে অবস্থিত একটি মসজিদে বাস্তুচ্যুত লোকদের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৮২৭ জনে। আর আহত হয়েছেন ৯৬ হাজার ৯১০ জন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ডটিতে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি খান ইউনিসে চলে যায়।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১১ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
সন্তানের জন্য পিতা দোয়া করেছিলেন, তার ছেলে যেন মসজিদে নববির ইমাম হন, আল্লাহতায়ালা তাকে কবুল করেন মসজিদে হারামের ইমাম হিসেবে! এই সন্তান হলেন- সদ্য মসজিদে হারামে ইমাম হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শায়খ ওয়ালিদ আশ শামসান।
৩ অক্টোবর (২০২৪) মসজিদে হারাম এবং মসজিদে নববির পরিচালনা পরিষদের প্রধান শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস রাজকীয় আদেশ অনুসরণ করে মসজিদে হারামের ইমাম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ অঞ্চলের উনাইযার আল কাসিমে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম আল ওয়ালিদ বিন খালেদ বিন ইবরাহিম আল শামসান।
এই অঞ্চল শত শত বছর ধরে বিখ্যাত বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ছেলে ওয়ালিদের ৪০ বছর বয়সে (২০১৩ সালে) বাবা খালেদ বিন ইবরাহিম আল শামসান সামাজিক মাধ্যম এক্সে পোস্ট করেন, ‘সন্তান যেন মসজিদে নববির ইমাম হতে পারে, এ জন্য তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়াও করেন।’
সন্তানের জন্য পিতার আকাঙ্ক্ষামূলক দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করেন আরও উত্তমভাবে। সন্তান নিয়োগ পেয়েছেন পবিত্র কাবার ইমাম হিসেবে।
রোববার (৬ অক্টোবর) ফজরের নামাজের ইমামতির মধ্য দিয়ে কাবার এই নতুন ইমাম তার যাত্রা শুরু করেন। অবশ্য আগে থেকেই কাবা প্রাঙ্গণে ইমামতি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে শায়খ আল ওয়ালিদ আশ শামসানের।
গত বছর তিনি মসজিদে হারামের তারাবির নামাজের অতিথি ইমাম হিসেবে নিয়োগ পান। শায়খ আশ শামসান নরম সুরে কোরআন তেলাওয়াত এবং মিষ্টি কণ্ঠের জন্য প্রসিদ্ধ। গতবছর তারাবি, তাহাজ্জুদ ও বিতরের নামাজে তার কোরআন তেলাওয়াত, উচ্চারণ ও অর্থের সঙ্গে মিল রেখে তেলাওয়াতের জন্য খুবই প্রশংসিত হয়। সুরা আর রাহমান, সুরা আল ওয়াকিয়া, সুরা কাফ তিনি যে ভিন্ন ধাঁচে রমজানের শেষ দিনগুলোতে তেলাওয়াত করেছেন, তা মক্কার পঁচিশ লক্ষাধিক মুসল্লিকে বিমোহিত করে।
শায়খ আল ওয়ালিদ আশ শামসান শুধুমাত্র একজন ইমামই নন। তিনি সৌদি আরবের একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। শরিয়া ও আইনশাস্ত্রে তার ব্যাপক পড়াশোনা রয়েছে। শায়খ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সৌদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরিয়ায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৫ সালে ইমাম এবং ধর্ম প্রচারক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সৌদি আরবের বিখ্যাত অনেক মসজিদে তিনি ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মসজিদে নববির প্রবীণতম ইমাম শায়খ আলী আল হুজাইফির কাছ থেকে হাফসের সনদ লাভ করেন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ সালাম রাবির কাছ থেকে শাতেবিয়া ও দুররা পদ্ধতিতে দশ কেরাতের সনদ গ্রহণ করেন।
সহকারী অধ্যাপক হিসেবে মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৪৩১ হিজরিতে মাত্র ইসলামের প্রথম মসজিদ মসজিদে কুবার ইমাম হিসেবে নিয়োগ পান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউবে তার অনেক ধর্মীয় বক্তৃতা এবং কোরআন তেলাওয়াত রয়েছে।
শায়খ আল ওয়ালিদের নিয়োগকে সৌদি জনগণ এবং মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ মসজিদে হারামের ইমামতিতে যে কেউ অধিষ্ঠিত হতে পারে না, এটি একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় পদ হিসেবে বিবেচিত।
বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভয়াবহভাবে দুর্বৃত্তায়নের ঘটনা ঘটে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জনগণের স্বার্থ ও হিতচিন্তার বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাদের এই দুর্বৃত্তায়নের অন্যতম শিকার। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের ভয়ানক অনিয়মের দরুন প্রতিষ্ঠানটি তার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা হারিয়েছে।
শনিবার(৫ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংস্কার ও দুর্নীতি নিরসনে লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত লেখক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
মাসিক মদিনার সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের প্রখ্যাত লেখক-অ্যাক্টিভিস্টরা উপস্থিত ছিলেন।
কামরুল হাসান নকিবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট শামসুল আরেফিন শক্তি। কিনোট উপস্থাপন করেন কবি ও সম্পাদক নেসারউদ্দিন রুম্মান।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বিগত সরকারের ফ্যাসিবাদী অনুচর ও অনিয়মকে নির্মূল করতে হবে এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চলমান দুর্নীতি ও অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে বক্তরা আরও বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সংস্কার ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের একটি অংশ। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশে মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অস্তিত্বপ্রশ্ন জড়িত। তাই এই সংস্কারভাবনাকে ছোটো করে দেখা মানে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়কে ছোটো করে দেখা।
এ সময় ইসলামি বইমেলায় দীর্ঘকাল যাবত চলমান নীতিহীনতা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন- মুহাদ্দিস ও লেখক মাওলানা যাইনুল আবিদীন, লেখক ও সিরাত গবেষক আমির ইবনে আহমদ, লেখক মাওলানা সাইমুম সাদী, লেখক ও আলোচক সালেহ আহমদ ত্বহা, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ডা. মেহেদী হাসান, লেখক মাওলানা মনযূরুল হক, লেখক ও সম্পাদক জিয়াউল আশরাফ, লেখক ও অনুবাদক আব্দুস সাত্তার আইনী, লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী, লেখক ও সম্পাদক এহসানুল হক, ক্যারিয়ার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আফজাল হুসাইন, লেখক ও অনুবাদক তানজীল আরেফীন আদনান প্রমুখ।
একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। এ জন্যই বলা হয়, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। আল্লাহতায়ালাও শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।
শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে, শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। বলতে গেলে এর বিকল্প নেই।
পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম আয়াতে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাসংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। ’ -সুরা আলাক : ১-৫
নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো।’ -আল মুজামুল আওসাত : ৬১৮৪
সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার ঐতিহ্য ও রীতি বেশ প্রাচীন। শিক্ষা অনুযায়ী মানবচরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাগিদ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর পরে, রাসূলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে জ্ঞানার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।’ -মিশকাত শরিফ
হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) একবার তার সওয়ারিতে (বাহন) ওঠার জন্য রেকাবে (সিঁড়িতে) পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরলেন। এ সময় জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, হে রাসুল (সা.)-এর চাচাতো ভাই, আপনি হাত সরান। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, না, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়। -আল ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ : ২/১৯৭
খেলাফতের যুগেই ইসলাম প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে তখন শিক্ষকের জন্য সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও দ্বীনি শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করতেন।
আর তারা যেহেতু নিজেদের জীবিকার পেছনে ব্যতিব্যস্ত সময় পার না করে, শান্ত-সৌম্য মস্তিষ্কে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাই তৎকালীন খেলাফত ব্যবস্থা বা সরকার তাদের সম্মানে অভিষিক্ত করেছিলেন। তাদের জ্ঞান বিতরণের এ মহৎ কাজকে সম্মান জানিয়ে তাদের পরিবার-পরিজনের যাবতীয় আর্থিক খরচ বহন করেছিলেন। যেন জীবনের তাগিদে শিক্ষকদের ভিন্ন কোনো পথে পা বাড়াতে না হয়।
হজরত উমর (রা.) ও হজরত উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনুল জাওজি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘সিরাতুল উমরাইন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.)-এর যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো। -কিতাবুল আমওয়াল : ১৬৫
হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)-ও তার যুগে ইয়াজিদ ইবনে আবি মালেক ও হারেছ ইবনে ইউমজিদ আশারি (রহ.)-কে ওই অঞ্চলে দ্বীন শেখানোর কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। বিনিময়ে তাদের জন্য সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। অবশ্য ইয়াজিদ (রহ.) তা গ্রহণ করলেও হারেছ (রহ.) তা গ্রহণ করেননি। -কিতাবুল আমওয়াল : ২৬২
বস্তুত ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে ইসলাম ও ইসলামের মনীষীরা শিক্ষক ও গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিতরণের দীক্ষাও দিচ্ছেন নিরন্তরভাবে।
মধ্য আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলীয় দেশ গ্যাবনের প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘গ্যাবনিজ রিপাবলিক।’ দেশটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে গিনি, উত্তরে ক্যামেরুন, পূর্ব ও দক্ষিণে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র অবস্থিত। গ্যাবনের মোট আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। উপকূলীয় সমভূমি ও পাহাড়ি ভূমির গ্যাবন প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
দেশটির মোট অর্থনীতির ৪৬ শতাংশ আসে তেল খাত থেকে। লিব্রভিল দেশটির সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী। একাধিক স্থানীয় ভাষা প্রচলিত থাকলেও গ্যাবনের দাপ্তরিক ভাষা ফ্রেন্স। গ্যাবনের জনসংখ্যা ২৬ লাখের মতো।
গ্যাবনের প্রধান ধর্ম খ্রিস্টান। পিউ রিসার্চের তথ্যমতে, মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম। তবে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০৫০ সালে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যার হার ১৯ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মন্তব্য করেছে পিউ রিসার্চ।
গ্যাবনের আদিবাসী ছিল পিগমি সম্প্রদায়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় বান্তু সম্প্রদায় পিগমিদের বিতাড়িত করে। আঠারো শতকে ‘মেইনি’ ভাষাভাষি মানুষ ‘কিংডম অব ওরোঙ্গু’ নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক গ্যাবনের ভৌগোলিক সীমা মূলত সে সময়ে নির্ণিত হয়। ‘কিংডম অব ওরোঙ্গু’ ছিল আফ্রিকার অন্যতম প্রধান দাস ব্যবসা কেন্দ্র।
১৮৭০ সালে দাস ব্যবসা বন্ধ হলে ওরোঙ্গু রাজ্যেরও পতন হয়। ১৮৮৫ সালে গ্যাবনে ফ্রান্সের আনুষ্ঠানিক ঔপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পর ১৯৫৮ সালে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা লাভ করে এবং ১৭ আগস্ট ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের নাগপাশ থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে মরক্কোর ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে গ্যাবনে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। এ সময় মরক্কোর ইসলাম প্রচারকরা আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলে চষে বেড়ান। খ্রিস্টীয় ১৫ শতকে গ্যাবনের ‘ফাঙ্গ’ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর মালি, নাইজার প্রভুতি মুসলিম দেশ থেকে আগত ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় ক্যামেরুনের ‘ফুলানি’ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। যাদের একাংশ গ্যাবনেও বসবাস করে। তারাও গ্যাবনে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখে।
তবে ১৯৭৩ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ইসলাম গ্রহণের পর গ্যাবনবাসীর মধ্যে ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস গ্যাবনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কেননা, এ মাসেই গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ইসলাম গ্রহণ করেন। অ্যালবার্ডের ইসলাম গ্রহণ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের’ একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে।
তারা বার্নার্ডকে পবিত্র কোরআনের একটি কপি এবং কাবার গিলাফ দিয়ে সম্মানিত করেন। এর সঙ্গে ছিল পবিত্র জমজমের পানি এবং মদিনার সুস্বাদু খেজুর। এ উপলক্ষে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের মহাসচিব অ্যালবার্ড বার্নার্ডকে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য তাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানান।
প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগোর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চিত্তাকর্ষক। এটা একটা ইতিহাস হয়ে আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। অ্যালবার্ড বার্নার্ড বানগো ‘ওমর বানগো’ নাম ধারণ করেন।
মধ্য আফ্রিকান দেশ গ্যাবনে ১৯৬৭ সালে মাবা সাত বছরের জন্য পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। অ্যালবার্ড বার্নার্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মাবা ওই বছরের নভেম্বরে মারা যান।
তখন মাত্র ৩১ বছর বয়সে অ্যালবার্ড বার্নার্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ তিনি একমাত্র পার্টিভিত্তিক এক সংবিধান ঘোষণা করেন। তিনি ২ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৯ সাল ও ১৯৮৬ সালেও তিনি এ পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৮ জুন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সে হিসেবে তিনি ৪২ বছরের বেশি সময় দেশটি শাসন করেছেন।
অ্যালবার্ড বার্নার্ড ১৯৫৯ সালে জসপাইন কামাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি তার স্ত্রীর ধর্ম ক্যাথলিকের প্রতি অনুরক্ত হন, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান হননি। পরে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্টের উৎসাহে ১৯৭৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি পবিত্র মক্কায় হজব্রত পালন করেন। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে তিনি ছয় দিনের এক সফরে সৌদি আরবের রাজধানীতে গমন করেন। এ সময় বাদশাহ খালেদ বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।
ওমর বানগোর নেতৃত্বে গ্যাবনে আন্তর্জাতিক মুসলিম সহযোগিতা সংস্থা ওআইসিতে যোগদান করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফিলিস্তিনের মতো মুসলিম ইস্যুতে গ্যাবন সাধারণত মুসলিম সম্প্রদায়কে সমর্থন দিয়ে থাকে।
আফ্রিকার অন্যান্য অমুসলিম দেশের তুলনায় গ্যাবনের মুসলিমরা বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে মুসলিমরা পৃথক ইসলামি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনার সুযোগ পায়, দুই ঈদসহ ধর্মীয় দিবসে ছুটি কাটাতে পারে, সরকারি প্রচার মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সুযোগ পায়, সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারে।
২০০৪ সালে গ্যাবনের মুসলিমরা প্রথমবারের মতো লিব্রভিলে প্রথম জাতীয় সম্মেলন করে। সম্মেলনে দেশটির ৩৪টি মুসলিম সম্প্রদায় ইসলামের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে।