কওমি মেরুদণ্ড যেভাবে সোজা রাখতে পারি

  • রশীদ জামীল, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কওমি মাদারাসার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত

কওমি মাদারাসার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের বিভাগীয় অঞ্চলভিত্তিক একটি শিক্ষাবোর্ড একজনের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকার জমি কেনার জন্য দরদাম করছিল, যদিও ওই বোর্ডের নিজস্ব একটি ভবন রয়েছে। ভবন থাকার কারণে বোর্ড তার স্থাবর সম্পদ বাড়াতে পারবে না- আমরা এ কথা বলছি না। বলতে পারি না, বলা উচিতও না। তবে আমরা সবিনয়ে যে প্রশ্নটি রাখতে চাই তা হলো- কোনটি বেশি জরুরি, আর্থিক উন্নয়ন নাকি অবকাঠামোগত পদক্ষেপ? শিক্ষাব্যবস্থার পরিশুদ্ধি নাকি আর্থিক সম্প্রসারণ?

আমরা আরেকটি আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ডের কথা জানি। তাদের সর্বশেষ আর্থিক রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের ফান্ডে আছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না এই টাকার বেশিরভাগই ছাত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফি বাবদ আদায় করা। আমরা কি তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতে পারি না, আপনাদের বোর্ড এই দুঃসময়ে শিক্ষকদের জন্য কিছু ভাবছে কি না?

দু’টি আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ডের কথা বললাম। অন্য বোর্ডগুলোর আর্থিক অবস্থা কি এ থেকে অনুমান করে নেওয়া খুব কঠিন? শুনেছি, শীর্ষস্থানীয় একটি বোর্ডের বাৎসরকি আয় নাকি ৩১ কোটি টাকা। এভাবে বোর্ডগুলোর তহবিলে যে পরিমাণ অলস টাকা পড়ে আছে, তার চার ভাগের একভাগও যদি এই দুর্দিনে কওমি শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক সমাজের মাঝে বিতরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে কি একজন শিক্ষকও অর্থকষ্টে থাকতেন?

বিজ্ঞাপন

কওমি শিক্ষাবোর্ডগুলো পুঁজিপতিদের মতো বড় বড় ভবন বানানোর পেছনে মনোনিবেশ না করে ছাত্র-শিক্ষক এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই ভাববে- এই আশা করার অধিকার কি আমাদের থাকতে পারে না? বোর্ডগুলো দুর্দিনে সংশ্লিষ্ট ছাত্র-শিক্ষকের সাহায্যে এগিয়ে আসবে- এই আশা করা কি অন্যায়?

আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আশা করি, কথাগুলোকে কেউ সেভাবে ব্যাখ্যায় নেবেন না। বিশেষ কোনো বোর্ডকে টার্গেট করা যদি আমাদের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আমরা খতিয়ানওয়ারি তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করতাম। যেমন-

বিজ্ঞাপন

একটি শিক্ষাবোর্ড যদি ছাত্রদের কাছ থেকে ভর্তির সময় ৫ টাকা করে কল্যাণ ফান্ডে জমা নিয়ে থাকে, বোর্ডটির বয়স যদি (ধরা যাক) ২৫ বছর হয়, প্রতি বছর যদি ওই বোর্ডের অধীনে ৩ হাজার মাদরাসা থেকে গড়ে ৩শ’ করে ছাত্র ৫ টাকা হারে জমা দিয়ে থাকে, তাহলে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা হওয়ার কথা। (৫ টাকা এখন ১৫-২০ টাকায় উন্নীত হয়েছে, তার পরও আমরা হিসাবটা ৫ টাকাতেই করলাম)।

এটা তো আয়ের মাত্র একটি দিক। যদি ছাত্রদের কাছ থেকে নেওয়া কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফি, মাদরাসাগুলো থেকে আদায় করা বিভিন্ন ফি’র অংক হিসাবে যোগ করা হয়; তাহলে ফান্ডের অংক কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে?

দেখুন, আমরা অসন্তুষ্ট নই। কওমি বোর্ডগুলো আর্থিকভাবে স্বনির্ভর এবং শক্ত হলে আমরা খুশি হই, ভালো লাগে। তবে আরও ভালো লাগবে যদি কল্যাণ ফান্ডের টাকাগুলো ছাত্র-শিক্ষকের বিপদের দিনে কল্যাণকর খাতে খরচ হতে দেখি। বোর্ডগুলো হয়তো মাঝে-মধ্যে বিশেষ কাউকে বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকতে পারে (যারা পেয়েছেন, তারা বোর্ডের কর্তা ও নেতৃস্থানীয়। আর অনুদানের হার ৫ লাখ ও দশ লাখ)। হয়তো কল্যাণকর কোনো খাতে কিছু টাকা খরচ করে থাকতে পারে। আমরা এ বিষয়ে জানি না। আর কোনো বোর্ড শুধু নয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয় সেভাবে প্রচার হয় না। সেটা আমরা আশাও করি না। সব ব্যাপার প্রচার করে বেড়ানোর বিষয় নয়- এটা আমরাও জানি। কিন্তু, কল্যাণ ফান্ড থেকে কাউকে সহায়তা করা হলে, অথবা এ পর্যন্ত মোট সহায়তার পরিমাণ কতো- একটি বা যেকোনো শিক্ষাবোর্ড এতটুকু তথ্য সংশ্লিষ্টদের জানাতেই পারে।

বোর্ডগুলো কী করতে পারে
১. যেহেতু এ বছর আর পরীক্ষা হচ্ছে না বলে ধরে নেওয়া যায়, তাই আদায়কৃত ফি’র পুরোটা শিক্ষকদের কল্যাণে দিয়ে দিতে পারে। পরীক্ষা হলে বোর্ডের ফান্ড থেকে খরচ বহন করা হবে। আর এতটুকু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা যদি বোর্ডের না থাকে, তাহলে ছাত্রদের কাছ থেকেই আবার ফি আদায় করবে।

২. বোর্ডগুলো তাদের খাজানা থেকে মোট জমার ২৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে পারে দুর্গত ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য। বোর্ডের সঙ্গে সংশিষ্ট বা কর্তৃপক্ষের প্রায় নব্বই শতাংশই আলেম। তারা তো আজীবন বয়ান করলেন, দিলে ধন কমে না। দিলে যে আসলেই কমে না- ব্যাপারটি অনুধাবনের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেন।

৩. বোর্ড কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্টজন এবং শুভাকাঙ্খিদের অংশগ্রহণে একটি আপৎকালীন কল্যাণ ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সমাজের বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করতে পারেন।

উল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে বোর্ডগুলো যদি সদয় হয়, তাহলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জন্য একটি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কমিটি করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্টরা ব্যাপারটি বিবেচনায় নিতে পারেন।

মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কী করতে পারে
মাদরাসা পরিচালনা কমিটি শিক্ষকদের বকেয়া বেতন এবং আপৎকালীন ভাতার ব্যাপারে আপাতত যে উদ্যোগটি নিতে পারেন-
১. পরিচালনা কমিটি মুহতামিম সাহেবের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আপৎকালীন একটি ফান্ড গঠন করার উদ্যোগ নিতে পারেন।
২. মুহতামিম সাহেব দ্বীনদার মুসলমানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিশেষ অনুদান সংগ্রহের চিন্তা করতে পারেন।
৩. মাদরাসার যেকোনো ফান্ডে টাকা থাকলে আপাতত সেই ফান্ড থেকে ধার করে হলেও শিক্ষকদের বেতনটা পরিশোধ করা যেতে পারে।

ছাত্রদের কি কিছু করার আছে
ছাত্রদেরই এখন সবচে’ বেশি করার সময়। ছাত্ররা যা করতে পারবে, কোনো মাদরাসা বা শিক্ষাবোর্ড সেটা করতে পারবে না। না পারার কারণ, এই দুই লাখ উস্তাদের প্রতি ছাত্রদের যে দরদ আর মহব্বত কাজ করবে, তার ন্যূনতম মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষাবোর্ডের মাঝে করবে না।

একটি মাদরাসায় ৫শ’ ছাত্র আছে। শিক্ষক ২০ জন। এই ছাত্ররা যদি সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের যে উস্তাদগণ খেয়ে না খেয়ে সারা বছর পড়িয়েছেন, যারা বছরের পুরোটা সময় নিজের সন্তানের মুখের দিকে না তাকিয়ে আমাদের চেহারার দিকে চেয়ে চেয়েই কাটিয়েছেন, আমরা আমাদের সেই উস্তাদদের চেহারায় বিষাদের ছাপ দেখতে চাই না। একজন উস্তাদকেও কষ্টে রাখতে চাই না। এই দু:সময়ে শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াব, কে কী করল না ভেবে আমরা যা করতে পারি সেটাই করব। তাহলে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের একজন কওমি শিক্ষককেও এই সময়ে অন্তত খাবারের কষ্টে থাকতে হবে না।

কাজটি কীভাবে হতে পারে
মাদরাসাভিত্তিক পরিকল্পনা হতে পারে। এ বছর যারা দাওরা বা মিশকাত জামাতের ছাত্র ছিলেন, তারা পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে ৫ জনের একটি কমিটি করতে পারেন। মিশকাত থেকে ২ জন, দাওরা থেকে দু’জন। পঞ্চমজন হবেন মাদরাসার মুহতামিম। মুহতামিমের নাম শুনে কেউ রাগ করলে বলি, এটা হবে মুহতামিমদের জন্য একটি মুয়াদ্দবানা... উপহার। শিক্ষা শব্দটি বলতে যেয়েও আর বললাম না। তবে, কাজ করবেন মূলত ৪ জন।

কাজটি হতে পারে দুই ধারায়
ফোনে হোক বা অনলাইনে, নিজ মাদরাসার অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ফান্ড সংগ্রহ করা। এই মাদরাসার সাবেক যে ছাত্ররা ভালো অবস্থানে দেশে আছেন কিংবা প্রবাসী, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তাদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করা।

উদ্যোগ নিলে কাজটি কিন্তু কঠিন না। একটি মাদরাসায় যদি ৫শ’ ছাত্র থাকে, যদি ২০ জন শিক্ষক থাকেন, তাদের গড় বেতন যদি ৫ হাজার টাকা করে হয়, তাহলে একমাসে তাদের বেতন হচ্ছে ১ লাখ টাকা। রজব শাবান আর রমজানের হিসাব করলে অংকটা দাঁড়ায় ৩ লাখে। ৫শ’ ছাত্র যদি তিন মাসের জন্য ৩শ’ টাকা করে দেয়, তাহলে ১ লাখ ৫০ হাজার হয়ে যায়। এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কৃতি ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে বাকিটা অনায়াসেই সংগৃহীত হয়ে যাবে- ইনশাআল্লাহ।

[ছোট ছাত্ররা হয়তো ৩শ’ টাকা দিতে পারবে না, কিন্তু তাদের অভিভাবক দিয়ে দিতে পারেন। ৫শ’ ছাত্রের সবাই হয়তো দিতে পারবে না, কিন্তু বাকিরা সামর্থ্যের আলোকে একটু বাড়িয়ে দিতে পারেন। সাবেক ছাত্রদের অংশগ্রহণ একটু বড় আকারে হতে পারে। এই অংক কিন্তু খুব বড় কোনো বিষয় নয়। এই পরিকল্পনার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়ন করা যায়- তবুও তো একটা কিছু হলো।]

যে ৪ জন ব্যবস্থাপনায় থাকবেন, ফান্ড হয়ে গেলে তারা সংশ্লিষ্ট উস্তাদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকাটা তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে মাদরাসার মুহতামিম সাহেবকে রিপোর্ট করবেন। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে, রাগে হোক আর আবেগে- ঢালাওভাবে মুহতামিম পদ নিয়ে নানা কথা বলে ফেলি। মনে রাখা দরকার, মাদরাসার মুহতামিমও কিন্তু একজন উস্তাদ। স্বল্পসংখ্যাক স্বেচ্ছাচারি মুহতামিমের কারণে গোটা মুহতামিম সমাজকে দোষারোপ করার প্রবণতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসব।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর শিক্ষার মেরুদণ্ড হলেন শিক্ষকগণ। চলুন, মেরুদণ্ড ঠিক রাখি। চলুন, হাতে হাত রাখি। মুহতামিম, মাদরাসা, শিক্ষাবোর্ড কী করল, না করল- সেটার হিসাব পরে মেলানো যাবে। আপাতত আমরা আমাদের পিতাদের পাশে দাঁড়াই। তারা আমাদের মানুষ করতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। আমরা যে কিছুটা হলেও মানুষ হতে পেরেছি- প্রমাণ করি, এখনই সেটা প্রমাণ করার শ্রেষ্ঠ সময়।

রশীদ জামীল: কলাম লেখক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা।

আরও পড়ুন:
কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন আবশ্যক

দুই লক্ষাধিক কওমি শিক্ষকের কথা ভাববার কেউ নেই!

কওমি শিক্ষকদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা