'হামার দুক্কো কায়ো দ্যাকে না'

  • ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নদী ভাঙন আর বন্যার থাবায় এখন ‍নিঃস্ব আফিজার রহমান।

নদী ভাঙন আর বন্যার থাবায় এখন ‍নিঃস্ব আফিজার রহমান।

'এ্যলা মাইনষে আইসে নদী দেইকপার। বানের পানি কমি যাওয়াতে সগায় এ্যলা নৌকাত চড়ি ঘোরাঘুরি নিয়্যা ব্যস্ত। কায়ো কায়ো তো খালি ফটোক তোলার জনতে আইসে। হামার দুক্কো কায়ো দ্যাকে না। বানের পানিত বসত ভিটা হারেয়া হামার সোগ শ্যাষ।'

এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আফিজার রহমান। রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলিগ্রামের বাসিন্দা তিনি।

বিজ্ঞাপন

গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুর পাশের গ্রামটি ছিল তার আদিনিবাস। নদী ভাঙন আর বন্যার থাবার সঙ্গে প্রতি বছরই লড়তে হয় তাকে। এবার তার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও কেড়ে নিয়েছে খরস্রোতা তিস্তা।

অন্যের ভিটায় ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘর তুলে কোনো রকমে কষ্টে দিন পার করছে আফিজারের পরিবার। তার চোখের সামনে এখন অনেক মানুষই আসে আর যায়। কারো কাছ থেকে দুই বেলা দু'মুঠো খাবারের জোগান মিলছে না তার। আফিজারের মতো এবারের বন্যায় হাজারো মানুষের বসত ভিটা ভেসে গেছে।

বিজ্ঞাপন
নদী ভাঙন আর বন্যার কারণে ঘর সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

তিস্তানদী বেষ্টিত নিম্নাঞ্চলে পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নেই তীব্র স্রোতের তোড়জোড়। তবে নদী ভাঙন না কমায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের অসহায় মানুষরা। এবারের বন্যায় বসতভিটা, গাছগাছালি, রাস্তাঘাটসহ গ্রামের পর গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চারদিকে থৈ থৈ পানি পেরিয়ে চর ইচলিগ্রাম। চরের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ইচলিগ্রাম। এখানকার বেশির ভাগ ঘরবাড়ি এখনো পানির নিচে। পরিবার পরিজন আর গবাদি পশুপাখি নিয়ে বন্যার মধ্যে চলছে টিকে থাকার লড়াই।

এখানকার আবুজর, রাজু মিয়া, ইব্রাহিম, মোসলেমা ও খাদিজা জানান, সরকারি অনুদান তো দূরের কথা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ঠিক মতো খোঁজ নিতে আসে নাই। অনেকের কপালে জুটছে না খাবারও। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও। ঘর বাড়ি সরিয়ে নিতে হচ্ছে অন্য জায়গায়। ঈদের আগে ও পরে কেমন কাটছে বানভাসিদের দিন, তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই।

একই আক্ষেপ পীরগাছার ছাওয়া ইউনিয়নের পাওটানা বোল্ডারেরপাড় গ্রামের বজরুর আলীর। তিস্তানদীতে চৌদ্দবার তার ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। তিনি বলেন, 'সবাই তো আসি হামার ছবি তোলে আর ভিডিও করে। কিন্তু কায়ো তো সমাধান করে না। এ্যলা ফির নদীর পাড়োত দূরদূরান্তের মাইনষে আইসে ঘোরাঘুরি করার জনতে। হামরা কান্দি বানের পানি দেকি। আর ওমরা আইসে ফূর্তি করার জনতে।'

অন্যদিকে তিস্তা তীরবর্তি কাউনিয়ার ভূতছড়া গ্রামের সবুর শিকদার বলেন, 'একে তো করোনাকাল, তার উপর আবার বর্ষাকাল। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে বন্যা ও বন্যা পরবর্তী নদী ভাঙন। মানুষের দুঃখ দুর্দশার অন্ত নেই। নদীপাড়ের এসব মানুষ এখন নিজেদের বসত ভিটা নিয়ে চিন্তিত।'

এদিকে সরেজমিনে তিস্তা বেষ্টিত গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলার বন্যাকবলিত কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার পানি কমে এসেছে। এসব এলাকার মানুষজন এখন সামান্য পানিতে তলিয়ে থাকা কৃষি জমিতেই স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত। কেউ কেউ নতুন করে ঘরবাড়ি গড়ে তুলছে। আবার অনেকেই অস্থায়ী ঠিকানাতেই কোনো মতে বাঁচার জন্য লড়ছেন।

দেখা গেছে, গঙ্গাচড়ায় তিস্তা সড়ক সেতু, কাউনিয়াতে তিস্তা রেল সেতু ছাড়াও পীরগাছার বোল্ডারেরপাড় ও পাওয়ার প্লান্ট এলাকায় বন্যার পানি কমে আসায় বেড়েছে বিনোদন পিপাসু মানুষদের উপচে পড়া ভিড়। পরিবার পরিজন, কেউবা একান্তই সময় কাটাতে এসব স্থানে ভিড় করছেন। কেউ কেউ নৌকায় চড়ে আনন্দ উল্লাসে ঘুরছেন। ছবি তোলারও হিড়িক রয়েছে এসব স্থানে। তবে বিনোদন প্রত্যাশীদের এমন আনাগোনায় কিছুটা হতাশ নদীপাড়ের অসহায় মানুষজন।

সরকারি ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি সামর্থ্যবানদের সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকা এসব বানভাসি ও ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষদের প্রত্যাশা, সমাজের বৃত্তবান ও সচেতন নাগরিক, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক নেতারা এবং জনপ্রতিনিধিরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে পাশে এসে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে নদী ভাঙন রোধ ও বন্যার ক্ষতি কমিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে নদী খনন, টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও নদী শাসনে পরিকল্পিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন জরুরি।