'এনপিপির হার্ট রওয়ানা দিয়েছে, আমরা এখন নির্ভার'
রূপপুর (পাবনা) থেকে ফিরেঃ হার্ট যখন রওয়ানা দিয়েছে এখন আর কোনো চিন্তা নেই। নির্ধারিত সময়েই রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র (এনপিপি) উৎপাদনে আসবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪ টাকার মতো পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সবচেয়ে ভারি এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ভিভিইআর-১২০০ (VVER-1200) চুল্লিপাত্র (রিয়্যাক্টর ভেসেল)। যন্ত্রটির ওজন ৩৪৭ টন। গত সপ্তাহে রাশিয়ার নভোরোসিয়েস্ক থেকে নদী পথে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে এটি। আর এই খবরে ২২ আগস্ট রূপপুরে ছুটে যান মন্ত্রী। সেখানে গিয়ে জেটি পরিদর্শন করেন, খোঁজ নেন ভারি এই মেশিনের ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতির খুঁটিনাটি। যন্ত্রপাতি খালাসের জন্য পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন স্থাপিত জেটি পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ডেপুটি ম্যানেজার আতিকুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, রিয়্যাক্টর ভেসেল আনার জন্য নদীর নাব্যতা প্রয়োজন সাড়ে ৪ মিটার। বর্তমানে প্রায় ১২ মিটারের মতো গভীরতা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমেও ৫ থেকে সাড়ে ৬ মিটার নাব্যতা রেকর্ড করা হয়েছে। সে কারণে যখনেই আসুক নাব্যতা সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভেসেল জেটিতে নামানোর জন্য দু’টি ক্রেন বানানো হচ্ছে। একেকটির ধারণ ক্ষমতা হবে ৩০৮ টন। আর এই ক্রেন দু’টি অ্যাসেম্বেল করার জন্য আরও ৬’শ টন ধারণ ক্ষমতার একটি ক্রেন আনা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আতিকুর রহমান বলেন, রাশিয়া থেকে কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর হয়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে সময় লাগে ২০ দিনের মতো। আর মংলা থেকে রূপপুরে আসতেও সময় লাগবে গড়ে ২০ দিনের মতো। সে হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে ভেসেল আসবে অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ। সেভাবেই চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্পের পরিচালক শৌকত আকবর বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভেসেল স্থাপনের জন্য চুল্লির কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। দৃশ্যমান হয়েছে ৩৪.৫ মিটার। জিরো মিটারের নিচে রয়েছে আরো ৩৫ মিটার। আর ডোমের (মসজিদের গম্বুজ আকৃতি) উচ্চতা হবে ৩৮ মিটার।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী বলেন, করোনায় অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই যথা সময়ে রিয়্যাক্টর ভেসেল শিপমেন্ট এই বড় ঘটনা। এটি হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির হার্ট। অবশিষ্ট যন্ত্রপাতিও যথা সময়ে আমরা পেয়ে যাবো। সেভাবেই সব এগিয়ে চলছে। আমাদের পক্ষ থেকে ইপিসি ঠিকাদার রাশিয়াতে তদারকি করছে কাজের অগ্রগতি। সম-সাময়িককালে কাজ শুরু করা অনেকে দেশ যথা সময়ে কাজ করতে না পারায় তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা সেদিক থেকে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি।
মন্ত্রী বলেন, রাশিয়া যে ঋণ দিচ্ছে এই ঋণের টাকা ২৮ বছরে পরিশোধযোগ্য। আমরা আশা করছি ২০ বছরের মধ্যে এর বিনিয়োগ উঠে আসবে। এরপর পুরো প্রফিটে চলবে আমাদের স্বপ্নের এই স্থাপনাটি। বার্তা২৪.কম’র এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হ্যাঁ এখন বলার সময়ে হয়েছে। এখন বলতে পারি আমাদের প্রতি ইউনিট খরচ পড়বে ৪ টাকার মতো।
মন্ত্রী বলেন, এটি শুধু একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। এর মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা অনেক বেড়ে যাবে। আমরা হবো ৩৮তম পরমাণু বিদ্যুতের দেশ। তখন দেখবেন আমাদের প্রকৌশলীদের মর্যাদাও বেড়ে যাবে। বিদেশিরা বলবে ওরা প্রযুক্তিধর দেশের লোক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে নিরাপত্তাই প্রথম, নিরাপত্তাই শেষ কথা'। জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সবকিছু করা হচ্ছে। আমরা কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে কোরক্যাচার স্থাপন করেছি। ফুকুশিমার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে চুল্লির তেজস্ক্রিয় পদার্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোরক্যাচার মাটির নিচে সিল্ড করে ফেলবে। বাইরে বেরিয়ে জন নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারবে না। রাশানরা বলেছেন এই কোরক্যাচার হয়তো কোনো দিনেই কাজে আসবে না। এতে আমাদের খরচটাও কিছুটা বেড়ে গেছে। তবুও আমরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই বাড়তি মিলিয়ন খরচ করেছি।
মন্ত্রী বলেন. এটি শুধু আমাদের নিজস্ব আইন নয়, আন্তর্জাতিক সকল অথরিটির আইন এবং সব ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ চলছে। আইইএ মনিটরিং করছে, তাই এখানে ইচ্ছা করলেই নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপোষ করার সুযোগ নেই।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেশিনগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করবে ২০২৩ সালের এপ্রিলে। অর্থাৎ ১৫ মাস থাকবে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে। দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০২৪ সালে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দুটি ইউনিট নিয়ে গঠিত, প্রতিটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন। ভারি সব যন্ত্রপাতি রাশিয়ায় তৈরি করে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। মূল পাঁচটি অংশের মধ্যে ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি শিপমেন্ট হয়েছে। আরো ১০ শতাংশ ম্যানুফেকচারিং চলমান।
ভিভিইআর-১২০০ চুল্লিবিশিষ্ট পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে 'থ্রি-প্লাস (৩+)' জেনারেশন শ্রেণীভুক্ত। এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে নতুন 'নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা (passive safety systems)' উদ্ভাবনের মাধ্যমে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপারেটরের সহায়তা ছাড়াই কাজ করতে পারে, এমনটি পুরোপুরি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও।
এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে রাশিয়া ৯০ শতাংশ দেবে ঋণ হিসেবে। অবশিষ্ট অর্থ যোগান দেবে বাংলাদেশ। কয়েক বছর আগে যারা রূপপুরকে দেখেছেন এখন গেলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। প্রতিদিনেই বদলে যাচ্ছে রূপপুর। বিশাল আকৃতির সুরম্য ভবন একটি টাউনশীপে রূপ দিয়েছে। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮০ শতাংশের মতো বলা হচ্ছে।