রাজবাড়ীর রক্তকন্যা স্মৃতি!
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু বাল্য বিয়ে হওয়ার কারণে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্নগুলো মাটিতে চাপা পড়ে। তিনি ভেবেছিলেন আর হয়ত তার দ্বারা কিছুই হবে না। কিন্তু না, থেমে যাননি। স্বামীর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় বন্ধুদের সহযোগিতায় নিজের স্বপ্নকে সাথে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অসহায় মানুষের জন্য। এখন তিনি ‘রক্তকন্যা’ নামে পরিচিত।
বলছিলাম পদ্মাপাড়ের মেয়ে পদ্মাকন্যা রাজবাড়ীর সোনিয়া আক্তার স্মৃতির কথা। ১৯৯১ সালের ১৭ নভেম্বর রাজবাড়ীর পাচুরিয়া ইউনিয়নের কোনাইল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ডাক নাম স্মৃতি হলেও অনেকেই তাকে রক্তকন্যা নামেই ডাকেন।
কারণ তিনি তার সংগঠনের মাধ্যমে ১০ বছরে এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার মূমুর্ষ রোগীকে বিনামূল্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন। তাছাড়া নিজেও ৬ বছরের ১৯ বার রক্ত দিয়েছেন।
বর্তমানে স্মৃতি দুই সন্তান আদনান ও তাজরীরকে সাথে নিয়ে রাজবাড়ী সদরের ৩ নং বেড়াডাঙ্গায় থাকেন। স্বামী খোকন আহামেদ প্রবাসী।
রক্তের জন্য একজন মানুষেরও যেন প্রাণ না যায় এই লক্ষ্যে তিনি একদল তরুণ-তরুণীকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রাজবাড়ী ব্লাড ডোনার্স ক্লাব’ নামে একটি অনলাইনভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
এই সংগঠন থেকেই তারা ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে স্বেচ্চায় রক্তদাতা জোগাড়, ফ্রি রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, নিয়ম অনুযায়ী রক্ত দিলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না এসব মানুষকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন স্কুল ও হাট-বাজারের মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সোনিয়া আক্তার স্মৃতি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ২০১১ সালে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে প্রিয় সন্তানকে বাঁচানোর জন্য এক অসহায় বাবা এক ব্যাগ রক্তের জন্য হাহাকার করছেন। সেটি দেখে আমার হৃদয় কেঁদে ওঠে। সেদিন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি- কোন মানুষই যেন রক্তের অভাবে মারা না যান। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে রক্তদাতা খোঁজা শুরু করি। সন্তান ছোট থাকার জন্য অনেকদিন নিজে রক্ত দিতে পারি নাই। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে নিজে নিয়মিত রক্ত দেওয়া শুরু করি। এখন পর্যন্ত ১৯ তমবার ও পজেটিভ রক্ত উপহার দিয়েছি।
এ সময় তিনি আরো বলেন, পথে-ঘাটে ইয়াং কোন ছেলে-মেয়েদের দেখলেই রক্তের গ্রুপ কি জানতে চাই। তাদের জিজ্ঞাসা করি রক্ত দেওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? যদি তারা আগ্রহ দেখায়, তাহলে ফোন নাম্বার আর লোকেশন জেনে নেই। অনেকেই আমাকে পাগল ভেবেও আমার কথা উড়িয়ে দেয় আবার অনেকেই মানবিক হাত এগিয়ে দেন।
প্রথমদিকে মাসে ২ থেকে ৩ জন করে রক্তদাতা ম্যানেজ করে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন দিনে রাজবাড়ী-ফরিদপুর মিলে ১৫ ব্যাগও রক্ত সংগ্রহ করে দিচ্ছি।
শুরুর পথটা দেখিয়েছে আমার বন্ধু পাপ্পুরাজ। সাথে ছিল পাভেল রহমান এবং নাজমুল হাসান রিপন। এছাড়া সাপোর্ট ছিলো আমার স্বামী খোকন আহামেদের।
এখন আমাদের সংগঠনটির রক্তদাতা সদস্যর সংখ্যা ৬ হাজারের উপড়ে। যারা নিয়মিত রক্ত দিতে প্রস্তুত। প্রতিদিন এখন ১০ থেকে ১৫ ব্যাগ রক্ত দিতেও আমরা সক্ষম। এখন স্বপ্ন দেখি এই বিশ্ব থেকে একদিন রক্তের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বিশ্ব হবে এবং সকল রক্তদান সংগঠনগুলো বিলুপ্ত হবে।
শুধু রক্ত নিয়েই কাজ করেন না তিনি। করোনাকালীন সময়েও তিনি লকডাউনের পরের দিন থেকে হ্যান্ডসেনিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক, বিনামূল্যে খাবার, দিয়েও অসহায় মানুষের পাশে ছিলাম। তাছাড়াও রাজবাড়ীর সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ভিত্তিক সংগঠন ‘রাজবাড়ী হেল্পলাইন’থেকে শীতার্তদের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রমেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
এরই মধ্যে তিনি প্রিয়বাসিনী বাংলাদেশ আ্যওয়ার্ড এবং খেয়াঘাটের পক্ষ থেকে সমাজকর্মী হিসাবে সম্মাননা পেয়েছেন।