দিশাহারা পানিবন্দি কৃষকেরা
ফরিদপুরে পানিবন্দি ১৫০ গ্রাম। জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ এবং সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এরই মধ্যে কাজিপুরের চরাঞ্চলের নানা স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙন। আর গোয়ালন্দে গোখাদ্যের তীব্র সংকটে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন পানিবন্দি কৃষকরা। এদিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদ ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি কমলেও ভাঙা বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বন্যায় প্লাবিত এলাকা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ১১টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আগামী দু’দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। গত এক সপ্তাহে বন্যাকবলিত এলাকার পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও উজানে বৃষ্টির কারণে ফের নদনদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, বগুড়ায় প্লাবিত এলাকায় ১১ হাজার ১৫০টি পরিবারের ৪৫ হাজার ২০০ জন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামালপুরে পানিবন্দি ২৫ হাজারের বেশি মানুষ; কয়েকটি উপজেলায় যমুনা নদীতে দেখা দিয়েছে ভাঙন। কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় ১০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও গাইবান্ধায় কিছু কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, যমুনা-বহ্মপুত্র এবং গঙ্গা-পদ্মার পানি যেভাবে বাড়ছে তা ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভাগ্যকূল ও মাওয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যেতে পারে। এ সময় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকায় নদনদীর পানি কমছে। দেশের নদনদীগুলোর ১০৯টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ১৬টি পয়েন্টে এখন পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর এখন মোটামুটি সক্রিয়, বঙ্গোপসাগরে এর সক্রিয়তা মাঝারি ধরনের। এ অবস্থায় আগামী কয়েক দিন বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
ফরিদপুরে গত কয়েক দিন ধরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে নিম্নাঞ্চলে প্লাবনের পাশাপাশি মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ ও পদ্মা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, গাছপালা ও বসতভিটা। জেলা সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের দেড় শতাধিক গ্রামের ফসল, রাস্তা ও নিচু এলাকার বসতঘর তলিয়ে গেছে।
যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিকেলে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। সব মিলে জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের অন্তত ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের সংকট।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে তিন সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর পানি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় তীরবর্তী দেবগ্রাম, দৌলতদিয়া, উজানচর ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার। ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি কৃষকরা। তাদের অনেকেই গোখাদ্য সংগ্রহে নৌকা নিয়ে পার্শ্ববর্তী উঁচু এলাকায় গিয়ে মাঠ থেকে ঘাস কেটে আনছেন।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির ফলে কাজিপুরের চরাঞ্চলের নানা স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ও পাট পানিতে তলিয়ে গেছে।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৪০ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকা ও চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী এলাকা এবং আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি উঠতে শুরু করেছে। ফলে ওই সব এলাকা ও নিচু এলাকার আমন বীজতলা, রোপা আমন, পাট, মরিচ, বেগুন, পটোলসহ নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে।
নীলফামারীর ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর পানি কমায় থেমেছে ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপনী ইউনিয়নের ভেণ্ডাবাড়ী গ্রামে তিস্তার বাঁধের ভাঙন। তবে বাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে লোকালয়ে নদীর পানি প্রবেশ অব্যাহত আছে। সেটি ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামতকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।