স্বর্ণরাঙা গুটিতে ধরেছে কৃষকের স্বপ্ন
স্বর্ণরাঙা মুকুলগুলো ক’দিন আগেও গাছের শাখা প্রশাখায় ঝলমল করছিল। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল গ্রামের সবুজ প্রকৃতি। চারপাশে মৌমাছির গুঞ্জরণ যেন নিমন্ত্রণ দিচ্ছিল আমের। কিন্তু সময় যত বাড়ছে অপেক্ষাও তত কমছে। এখন গাছের গাছের শাখে শাখে বেঁধেছে আমের গুটি দানা। আর সেই গুটিতেই স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করেছেন কৃষকরা।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাছ, পাতা, মুকুল, গুটি আর আম নিয়ে বাঁধা তাদের নানান স্বপ্নের কথা।
চাষিরা জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর সর্বোচ্চ মুকুলে ছেয়ে গেছে বরেন্দ্রের আম বাগান। মুকুলের ভারে নুয়ে পড়া আমগাছগুলোতে গুটি বাঁধতে শুরু করেছে সবুজ দানা। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে যেন উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট দানা। মুকুলের পর সবুজ দানাও নজর কাড়ছে সবার। মৌমাছির গুণগুণ শব্দ মুকুলের মৌ মৌ ঘ্রাণে স্বপ্নে বিভোর আম চাষিরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, গত মৌসুমে শীত ও কুয়াশা তুলনামূলক কম হওয়ায় মুকুলের ক্ষতি কমেছে অনেকটাই। সঠিক পরিচর্যা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ছড়িয়ে যাবে বলেও আশা করা যায়। এছাড়া রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া ও ক্রমেই তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি আমের জন্য সুবিধাই বয়ে আনবে।
কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে রাজশাহী জেলায় আম চাষ হয়েছিল ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে। আম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন। এ বছর জেলায় আম চাষ হচ্ছে ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ এবার জেলায় আমের চাষাবাদ বেড়েছে এক হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে। এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
জেলার আমের বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, আম গাছে কীটনাশক স্প্রে, গোড়ায় পানি দেওয়াসহ সব রকমের যত্ন আত্তি চলছে পুরোদমে। বিশেষ করে রাজশাহী নগরীর হেতেম খাঁ, গৌরহাঙ্গা, লক্ষ্মীপুর, শিরোইল, কোর্ট স্টেশন, ভেড়িপাড়া, মালোপাড়া, কাশিয়াডাঙ্গা, মেহেরচণ্ডি ও পদ্মা আবাসিক এলাকায় বেশ কিছু গাছে গুটি বাঁধতে শুরু করেছে আমের মুকুল। নগরীর বাইরেও আমের নাম-যশে পূর্ণ জেলার বাঘা, চারঘাট, মোহনপুর ও বাগমারা এলাকায় দেখা মিলেছে আমের গুটি। সোনালি মুকুল ঝরে ক্রমেই শক্ত হতে শুরু করেছে সবুজ গুটি। মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর সবুজ দানা জাদুর মতো কাছে টানছে আমপ্রেমীদের। অনবরত আম গাছের মগডালেই নজর কাড়ছে পথচারীদের।
জানতে চাইলে বাঘার আম চাষি সাদিকুল ইসলাম বলেন, আম গুটি হওয়া শুরু হয়েছে। এবার বাঘা অঞ্চলের গাছে প্রচুর মুকুল হয়েছিল, গতবারের চেয়ে প্রায় ডাবল। তবে খিরসাপাত ও ল্যাংরা আমে গুটি কম হচ্ছে। অনেক দিন বৃষ্টি ছিল না, মাটি শুষ্ক ছিল। মাঝে একটু কুয়াশা হয়েছিল, হপার নামের এক প্রকার পোকারও উৎপাত ছিল, এসব কারণে কিছু মুকুল ছোট থাকায় গুটি কম হয়েছে। আর লকনা, ফজলি বা আশ্বিনা আমে গুটি বেশি হচ্ছে। গত বারের চেয়ে ডাবলের বেশি আম উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
দুর্গাপুর উপজেলার আম চাষি আলতাফ হোসেন বলেন, আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। আবহাওয়াও মোটামুটি ভালোই আছে, মাঝে একটু পঁচানি ও হপার নামের রোগ ধরছিলে। কীটনাশক স্প্রে করার পর অনেকটাই সমাধান হয়েছে। আশা করি গত বারের থেকেও ফলন ভালো হবে।
রাজশাহী তানোর উপজেলার চাষি বারিউল ইসলাম বলেন, চাষ এবং ব্যবসা উভয়ের সঙ্গেই আমি সরাসরি যুক্ত। মূলত পাতা কেনা দিয়েই শুরু হয় আমের কেনা-বেচা। বেশি পাতাওয়ালা গাছে ফলন ভালো হবে ধরে এ পাতা কেনা-বেচা হয়। গাছপ্রতি ৫-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় মালিককে। অবশ্য যুগ যুগ থেকে পাতা কেনার এ প্রথা চলে এলেও এখন অনেকেই ভিন্ন নীতিতে ব্যবসা করেন। আগাম পাতা কেনায় ক্ষতির শঙ্কা থাকে। তাই ধীরে ধীর নিজেই বাগান গড়ে তুলেছি। এখন নিজেই চাষও করি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোজদার হোসেন বলেন, আমরা অনেক ভালো ফলনের আশা করছি এবার। মুকুল যেটা হয়েছে খুবই ভালো। এখন পর্যন্ত আবহাওয়াও ভালো রয়েছে, মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হবে, রোদ হবে। এখন পর্যন্ত খারাপ কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি। জেলায় প্রায় আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।