তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার দাবি
তামাক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটি পণ্য। তামাকের ভয়াল ছোবল প্রতিদিন কেড়ে নেয় ৪৪২ জন মানুষের প্রাণ। মৃত্যুর এই মিছিল ঠেকাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার দাবি জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল ১১ টায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারী মৈত্রী’র আয়োজনে 'প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ' শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় ।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আকতার ডলি। তিনি বলেন, তামাক নারীস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তামাক নিয়ন্ত্রণের নানান দিকগুলোর পাশাপাশি নারী ও শিশুদের নিয়ে ভাবা একান্ত জরুরী। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ধূমপান নারী ও শিশুদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে । বাংলাদেশে ধূমপান না করেও বছরে প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ বিভিন্ন ভাবে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। স্বাভাবিকভাবে নারী ও শিশুরাই সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে গর্ভধারণ ক্ষমতা লোপ পাওয়া, কম ওজনের বা মৃত শিশু জন্মদান, অকাল সন্তান প্রসব, জরায়ু ক্যানসারসহ ঋতুস্রাবের নানান জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় নারীদের। এছাড়াও, কম স্মৃতিসম্পন্ন সন্তান প্রসব করার সম্ভাবনাও তামাক সেবনের ফলে হতে পারে। এই বিষয় সম্পর্কে আমাদের অনেকটাই অজানা।
এছাড়া সিগারেটের ধোঁয়া শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ । কারন ধূমপানের ধোঁয়া সহজেই শিশুদের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুর নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, হাঁপানিসহ নানান ধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সচেতনতা, পাশাপাশি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নারীর কণ্ঠস্বরকে বলিষ্ঠ করার জন্য আমাদের সবাইকে একত্র হতে হবে। নারী ও শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধূমপান এবং তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী করার দাবি জানান তিনি।
টোব্যাকো এটলাস ২০১৮-এর তথ্যমতে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মানে প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ প্রাণ হারান এই ভয়ঙ্কর তামাকের আগ্রাসনে। তামাকের এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসনকে তাই আমরা তামাক মহামারী হিসেবেই গণ্য করছি বলে জানান তামাকবিরোধী সংসদীয় নারী ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম ।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধিত খসড়াতে ধূমপানের নির্ধারিত এলাকা বিলুপ্ত, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, খুচরা বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বন্ধ, ই-সিগারেট নিষিদ্ধ, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ ও সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবার্তার পরিসর ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যা আইনটিকে আরও শক্তিশালী করবে। ফলে তামাকের কারণে একদিকে যেমন মৃত্যুহার কমবে অপরদিকে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটবে।
শবনম জাহান শিলা জানান, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরী। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা হলে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমবে। একইসঙ্গে তামাক ব্যবহারের ফলে দৈনিক প্রাণহানির মিছিল কমানো সম্ভব হবে। তামাকের কারণে যেসব রোগ হচ্ছে সেই রোগের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে অনেক পরিবার দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। শধু তাই নয়, তামাকের কারণে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তামাকজনিত কারণে উৎপাদনশীলতা হারানো এবং চিকিৎসা বাবদ বছরে যে ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় হয়। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যত দ্রুত পাস হবে, তত বেশি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমবে।
মো. আব্দুস সালাম মিয়া বলেন, তামাকের প্রতি আসক্তি যুবসমাজকে ফেলে দিচ্ছে এক অন্ধকারজগতে। অল্প বয়সেই শিশু-কিশোররা ধূমপানে আসক্ত হয়ে পরছে। ভয়ঙ্কর শারীরিক অসুস্থতার মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পরছে তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে ‘গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো জরিপ’ শিরোনামে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে পরিচালিত এ জরিপ প্রতিবেদনে ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশে ধূমপান আসক্ত কিশোর-কিশোরীর হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ১২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত ধূমপানে আসক্ত। বর্তমানের যুগে মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো সচেতনভাবেই কিশোরদের টার্গেট করে থাকে।
কোম্পানিগুলো মনে করে, অল্প বয়স থেকেই যদি এই প্রজন্মকে সিগারেট ব্যবহার শুরু করিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তারা অন্তত ৬০ বছর পর্যন্ত সিগারেট সেবনের অভ্যাসে জড়িয়ে পড়বে। ধূমপান নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর এই কূটকৌশল বন্ধ করতে না পারলে বড় ধরনের সামাজিক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার জন্য দাবি জানানোর পাশাপাশি যুবসমাজের সুস্থ্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে সকলকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণে পাশে থাকার অনুরোধ করেন তিনি।
তামাকের কারণে আর একটি প্রাণও যাতে না ঝড়ে সে জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার পক্ষে দাবি জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের যুবসমাজ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। পাশাপাশি আমাদের অসচেতনতায় আমাদের পরিবার, আমাদের সন্তানেরা যাতে হুমিকির মুখে না পরে সেজন্য আমাদের নিজ থেকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তামাক বিরোধী সকল কার্যক্রমে নারী মৈত্রীর পাশে থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এ সময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নাছিমা বেগম, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ, শবনম জাহান শিলা, এ্মপি (সংরক্ষিত নারী আসন) এবং শিরিন নাঈম পুনম, সাবেক নারী সংসদ সদস্য।
সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মো. আব্দুস সালাম মিয়াহ, প্রোগ্রামস ম্যানেজার, ক্যাম্পেইন ফর ট্যোবাক ফ্রি কিডস বাংলাদেশ।