নয় বছরে ১ লাখ ৯০ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা, মৃত্যু সহস্রাধিক
সারা দেশে গত নয় বছরে ১ লাখ ৯০ হাজার ১৬৭টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ হাজার ৫১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৬০৬ জন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘ভবন বিপজ্জনকতায় আচ্ছন্ন নগরী: প্রেক্ষিতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এ তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এবং বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল'ইয়ার্স এসোসিয়েশন (বেলা)।
ইকবাল হাবিব বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে নগরায়নের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-১১ অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলার কথা বলেছে। কিন্তু এখনো আমরা একটি নিরাপদ এবং অভিঘাত সহনশীল নগরী গড়ে তুলতে পারিনি। নগরে ঘটিত অগ্নি দুর্যোগ আজ বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। অগ্নিদুর্যোগ প্রতিরোধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সামগ্রিক কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, জরুরি ভিত্তিতে উদ্ভূত অগ্নি নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’ রোধপূর্বক নিরাপদ নগরী গঠন নিশ্চিতে যথাযথ ও সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমোদিত ব্যবহার পরিবর্তন অথবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত করা হচ্ছে অথবা ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করার কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছে। একটি রেস্তোরাঁ স্থাপনে অনাপত্তিপত্র, রেস্তোরাঁর লাইসেন্স, লাইসেন্স নিবন্ধন/নবায়ন, দোকান লাইসেন্স, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স, ই-ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফায়ার লাইসেন্স, অনাপত্তি/পরিবেশগত ছাড়পত্র, এবং অবস্থানগত ছাড়পত্র এরকম ১০টি প্রত্যায়নপত্র প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সকল ছাড়পত্র যথাযথ পরীক্ষা- নিরীক্ষা এবং তদারকি ছাড়াই প্রদান করা অথবা ছাড়পত্রহীনভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিরুদ্বেগ থাকার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আইনের ব্যত্যয় এবং তদারকির অভাবে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া এই অগ্নিকাণ্ডগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো অর্থাৎ, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহ, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা (ওয়াসা, তিতাস, ডিপিডিসি/ডেসা), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সর্বোপরি ভবন মালিক দায়ী।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, দেশে অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমরা আজকে এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে, এই অর্থনীতি পরিচালনা করার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠা উচিত সেটি এখনো তৈরি হয়নি। এটিই হলো বাস্তবতা। আমাদের অর্থনীতির বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক।
তিনি আরও বলেন, দেশের নগরগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ট্র্যাজেডিগুলো বেশি হচ্ছে। আমাদের নগরায়নের যে ধরণ সেটি অতিরিক্ত পুঞ্জিভূত। নতুন নতুন নগরগুলো যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী করা যেত তাহলে মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে শহরে এসে নিরাপত্তাহীনতায় পড়া লাগতো না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নুরমোহাম্মদ তালুকদার বলেন, রানা প্লাজা থেকে শুরু করে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড সবগুলো একই সূত্রে গাঁথা। ভবনের মালিকরা হলো লোভী। তাদের কাছে জাত-পাত, দেশ, ধর্ম-কর্ম কিছু নাই। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, সেটি হলো প্রফিট (লাভ) করা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষের জীবন যাচ্ছে। রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চালিয়ে যেসকল সাধারণ কর্মী আছে শুধু তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর কারণ, তারা দুর্বল। কিন্তু, ভবন মালিকরা শক্তিশালী হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি, একজন রেস্তোরাঁর কর্মীকেও যেন গ্রেফতার করা না হয়। তারা একদমই সাধারণ প্রান্তিক জনগণ। মূল দোষী হচ্ছে ভবন মালিকরা। ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ভিডিও কলে যুক্ত থেকে বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ার্স এসোসিয়েশনের (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে মানুষের জীবনের মূল্যের দাম দিতে হবে। দেশ এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। ব্যবসায়ী মডেলে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসায়ী মডেলে দেশ পরিচালিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের অবস্থা ভালো হবে না। ঢাকায় নতুন নতুন বিল্ডিং হবে আর এই বিল্ডিংগুলো এক-একটা আগুনের গোলায় পরিণত হবে।
করণীয়
>> ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে উল্লিখিত ৬টি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনপূর্বক নগরীতে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তার দ্রুত যথাযথকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্য শহরগুলোতেও এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এর তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট ভবনসমূহের সামনে দৃশ্যমানভাবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
>> ঢাকা শহরজুড়ে বিদ্যমান প্রায় ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ (ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৩) অবৈধ/অননুমোদিত/অনুমোদিত কিন্তু ব্যত্যয়কারী ভবনসমূহকে ড্যাপে অনুসৃত বিধান অনুযায়ী যথাযথকরণে ইতিমধ্যকার গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা দ্রুততম সময়ে অনুমোদন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
>> নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংস্থা হিসেবে সিটি কর্পোরেশনগুলোর নেতৃত্বে অন্যান্য অংশীজনের মাধ্যমে ভবনের প্রতি বছর নবায়নযোগ্য ব্যবহারযোগ্যতার সনদ এ ভবনের প্রবেশ অঞ্চলে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
>> জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-এর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী ‘বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ)’ প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র বাংলাদেশের সব ভবন নিরাপদ করার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
>> ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিভিল ডিফেন্স অংশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরির কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে হবে। সব শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবনে এরূপ প্রশিক্ষিত জনগণের নিয়োগ প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে।
>> সব সাংঘর্ষিকতা ও অস্পষ্টতা পরিহারপূর্বক অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণতা নিশ্চিত করে যথাযথকরণের আশু উদ্যোগ নিতে হবে।
>> বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের তৈরিকৃত স্ট্যান্ডিং অর্ডার ফর ডিজাস্টার’ অনুযায়ী কোনো দুর্যোগ সংঘটিত হলে তা মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্ব প্রদান করার বিধানটি পর্যালোচনাপূর্বক বাস্তবোচিত ও যথাযথকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
>> ফায়ার স্টেশনবিহীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টসমূহে জরুরি ভিত্তিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বর্তমানে উদ্যোগ গ্রহণ করা স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনা করার সার্বিক ও সর্বাঙ্গীণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে দেশজুড়ে স্থাপিত শিল্পাঞ্চলগুলো অগ্নিদুর্যোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করে।
>> অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মিত গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় আধুনিক প্রযুক্তির নির্ভরতায় ‘স্মার্ট প্রচার ও জনসংযোগ’-এর ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে।
>> আগুন নির্বাপণে প্রয়োজনীয় পানি সংস্থানের উৎস হিসেবে নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা’ করে বর্তমান ঘনবসতিপূর্ণ নগরায়ণে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাপা'র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বাপা'র যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদারসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।