শাহ আমানত বিমানবন্দর

যাত্রীদের সামনে অপেক্ষা করে ‘আকাশ সমান’ হয়রানি!



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
লাগেজ সংগ্রহ করতে এসে যাত্রী দেখেন তার ৭৪ হাজার টাকার মালামাল হাওয়া

লাগেজ সংগ্রহ করতে এসে যাত্রী দেখেন তার ৭৪ হাজার টাকার মালামাল হাওয়া

  • Font increase
  • Font Decrease

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদের বাসিন্দা মোহাম্মদ আরমান থাকেন সৌদি আরবের মদিনায়। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরবেন। সেজন্য আত্মীয়-স্বজনের জন্য নামিদামী উপহারসামগ্রী নেন প্রবাসী এই ব্যবসায়ী। দেশে আসার দুই সপ্তাহ আগেই এসব মালামাল বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইনসের একটি ফ্লাইটে পাঠিয়ে দেন শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আর তিনি ফেরেন ৩ মার্চ। এরপর ৪ মার্চ বিমানবন্দরে নিজের পাঠানো লাগেজ সংগ্রহ করতে হাজির হন এই সৌদি প্রবাসী।

অতিরিক্ত মালামাল বহনের ভাড়া এবং শুল্কযুক্ত পণ্য আনায় আরমানকে দিতে হয় অতিরিক্ত ৪০ হাজার টাকাও। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শাখায় টাকা জমা দেওয়া শেষে লাগেজ বুঝে নিতেই চোখ কপালে ওঠে আরমানের। কারণ তার লাগেজ কাটা-ছেঁড়া! পরে দেখেন তার লাগেজ থেকে ৭৪ হাজার টাকার ৭ কেজি মালামাল হাওয়া। পরে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেও পাননি কোনো সদুত্তর।

দৃশ্যপট-২. চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি সকালে এই বিমানবন্দর দিয়ে ফ্লাই দুবাইয়ের ফ্লাইট এফ জেড-৫৬৪-যোগে দুবাই যাওয়ার পথে ৮ যাত্রীকে (সকাল ৬টা থেকে ১০ টার মধ্যে) আটকে দেন সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মীরা। পরে নানান অজুহাত দেখিয়ে এই যাত্রীদের কাছে থাকা ৫ হাজার ৮০০ বাংলাদেশি টাকা ছিনিয়ে নেন তারা। সেদিন বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করার সময় কয়েকজন যাত্রী তাকে বিষয়টি জানান। তবে টাকা ফেরত পাননি এই যাত্রীরা। বিষয়টি পরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানায় ফ্লাই দুবাই।

দৃশ্যপট-৩: গত বছরের ৬ নভেম্বর ঘুষের টাকা না পেয়ে বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এসআই রাজীবের নেতৃত্বে নুরুল আমিন নামের এক সৌদি আরবগামী যাত্রীকে বিমানবন্দরের একটি কক্ষে আটকে রেখে মারধর করা হয়। এ সময় তার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়। এই কারণে তিনি ওইদিন তার ফ্লাইটে বিদেশ যেতেও পারেননি। অবশ্য ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে এপিবিএনের দুই সদস্যকে প্রত্যাহার করে দায় সারা হয়।

এভাবেই চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর যেন যাত্রীদের কাছে দিন দিন হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়। এই বিমানবন্দর দিয়ে ভ্রমণ করেছেন, আর ভোগান্তিতে পড়েননি-এমন যাত্রী যেন পাওয়া যাবে খুব কমই। অথচ এটি কিনা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর, যেদি দেশের প্রায় ২১ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করেন। গত এক বছরে এই বিমানবন্দর দিয়ে ভ্রমণ করেছেন ১৬ লাখ যাত্রী। আর এতে রাজস্ব আয়ও হয়েছে বিপুল পরিমাণ, ২২৫ কোটি টাকা। কিন্তু যে যাত্রীদের কল্যাণে এত এত আয়-সেই তারাই যেন এখানে হয়ে পড়েন ‘অবহেলার পাত্র’! গত বছরের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনেও এই বিমানবন্দরের নানা অনিয়ম, যাত্রীদের হয়রানির চিত্র উঠে আসে।

এই বিমানবন্দর ব্যবহার করা যাত্রীরা এই হয়রানি-দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চেয়েছেন। গত ৮ মে বিমানবন্দরে আয়োজিত বিমানবন্দরে সেবার মান উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে আয়োজিত গণশুনানিতে নানা অভিযোগ তুলে ধরে দ্রুত এসব থেকে পরিত্রাণ চান তারা।

কী আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে:

গত ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তিন পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সবিস্তার তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বেবিচক অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (অ্যাভসেক) শাখার দুর্নীতি নিয়ে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ভৌত নিরাপত্তা নিশ্চিতে অ্যাভসেক শাখার নিজস্ব সিকিউরিটি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে অ্যাভসেক শাখার সদস্যরা বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশের নামে টাকা নেওয়া, স্বর্ণ ও ইয়াবা চোরাচালান, হুন্ডি পাচার, বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের কর্ণধার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল দেওয়ার নামে অর্থ আদায়সহ নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছেন। অ্যাভসেক শাখার সহকারী পরিচালক মো. নজরুল ইসলামের প্রশ্রয়ে এসব অনিয়ম করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

বেবিচকের এস্টেট শাখার দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের এস্টেট শাখার সাবেক শাখাপ্রধান মো. মশিউর রহমানের দায়িত্বকালীন এই শাখায় সাতটি ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়। বিমানবন্দর টার্মিনালের কোনো স্পেসের ইজারা নিতে বা নবায়ন করতে ঘুষ নেওয়া, ইজারাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর নির্মাণকালে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে বরাদ্দ করা প্লটের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় ঘুষ বাণিজ্য, রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মতো অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন মশিউর রহমান। তাকে ঢাকা বিমানবন্দরে বদলি করা হলেও তার সহযোগীরা এখনো একই কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া এস্টেট শাখার বর্তমান সহকারী পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিল বিভিন্নভাবে ঘুষ নিচ্ছেন।

বেবিচক ইএম শাখার দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, ইএম শাখা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইএম শাখার সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আজিম উদ্দীন এবং মো. আশরাফুল হোসেন শাহিন শাখার কাজে টেন্ডারে কাজ পাওয়া যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত ঘুষ নেন। এ ছাড়া এই শাখার মেকানিকস দেবপ্রিয় সিংহ, সহকারী মেকানিকস মো. ইউনুস, ওয়্যারম্যান মো. আবদুল কাদের, হেলপার মো. ফিরোজ, অফিস সহায়ক ওসমানের সহায়তায় এ শাখায় অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে।

বেবিচক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার দুর্নীতিও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী আবদুল আলিম বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বিমানবন্দরে যেকোনো উন্নয়ন কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেন।

আনসারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর টার্মিনালের আগমন/বহির্গমনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অন্তত ২০০ আনসার সদস্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত। বর্তমানে এরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে বেশি জড়িত। যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশ আদায় করেন তারা। কোনো কোনো সময় বিমানবন্দরের ড্রাইভওয়েতে প্রবেশের জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা হয়। এসব বকশিশের টাকার অংশ শাখার ইনচার্জও পেয়ে থাকেন।

এপিবিএনের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে এপিবিএনের সদস্যরা বিমানবন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। যাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের মূল্যবান মালামাল আত্মসাৎ করা হয়।

এছাড়া কাস্টম এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন এয়ারলাইনসের দুর্নীতিও তুলে ধরা হয়।

অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি বিমানবন্দরের যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে। পাশাপাশি যাত্রীদের হয়রানি ও ভোগান্তি দূর করতে বেশ কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিএ-১ অধিশাখা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২৩ নভেম্বর বেবিচককে নির্দেশ দেয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর বেবিচকের বোর্ড সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমোডর মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান খান চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে খাতওয়ারি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা বেবিচককে অবহিত করার জন্য গত ২৬ নভেম্বর নির্দেশনা দেন।

হয়রানির শিকার যাত্রীদের বক্তব্য:

বাড়তি অর্থ দেওয়ার পরও নিজের লাগেজটা ঠিকঠাক না পাওয়ার দুঃখ এখনো পোড়ায় সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ আরমানকে। আফসোস নিয়ে বললেন, ‘কর্মকর্তাদের সামনেই লাগেজ মেপে দেখা যায় ৭ কেজি মালামাল কম ছিল। বাংলাদেশি টাকায় ৭৪ হাজার মালামাল চুরি হয়ে যায়। অথচ লিখিত অভিযোগ দিতে চাইলেও কেউই আর এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে কোনো উপায় না পেয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। আত্মীয়দের জন্য শখ করে কেনা মালামালগুলো আর তাদেরও দেওয়া হলো না।’

যদিওবা লাগেজে কাটা থাকলেও সেটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে হয়নি বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের হারানো ও প্রাপ্তি শাখায় কর্মরত মোহাম্মদ ইকবাল খসরু।

তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ লাগেজ কাটার ঘটনা যে দেশ থেকে আসে ওই দেশে হয়ে থাকে। কেননা ইলেক্ট্রনিক পণ্য থাকলে তা স্ক্যানে আটকে যায়। তখন ওই দেশের এয়ারপোর্টেই তা কেটে রেখে দেওয়া হয়। এখানে কাটার সুযোগ নেই। কেননা বিমানবন্দরের সবখানেই ক্যামেরা আছে।’

আরেক সৌদি আরব প্রবাসী নুরুল আমিন তো এপিবিএনের সদস্যদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো আৎকে উঠেন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বড়হাতিয়ার বাসিন্দা নুরুল আমিন থাকেন সৌদি আরবের মদিনায়।

নুরুল আমিন বলেন, ‘ওইদিন বিকেল ৫টার বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরে যাই। গাড়ি পার্কিং নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি হলে এপিবিএনের এক এএসআইয়ের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করেন এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। কাছ থেকে বাঁচতে চিৎকার শুরু করলে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা অন্য কক্ষে নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করেন। পরিবারের সদস্যদের সামনে থেকে তুলে নিয়ে আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। সেই কারণে আমার ফ্লাইটও মিস হয়।’

এই বছরের ৬ জানুয়ারি যে আটজন যাত্রীর কাছ থেকে জোরপূর্বক বাংলাদেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের একজন হাফেজ মো. খায়রুল বাশার। তার কাছ থেকে সেদিন এক হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই বলে বাংলাদেশি টাকা যা আছে দিয়ে দেন। প্রতিবাদ করলে নানা নিয়মের ভয় দেখান। বাধ্য হয়ে টাকাটা দিয়ে দিই।’

এই বিমানবন্দর দিয়ে বহুবার আরব আমিরাতের দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করেছেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির বাসিন্দা সাইদুল হক। দুবাই-প্রবাসী সাইদুল বলেন, ‘কয়েক বছর পর পর দেশে আসতে পারি। দেশে যাওয়া যে কোনো প্রবাসীর কাছেই আনন্দের। কিন্তু আমাদের সেই আনন্দ মাটি হয়ে যায় শাহ আমানত বিমানবন্দরে এলে। এখানে যেন আমাদের সামনে আকাশ সমান ভোগান্তি অপেক্ষা করে। লাগেজ টানাটানি, লাগেজ থেকে মালামাল চুরি, নানা অজুহাত ও ভয় দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া, ঘুষ না দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হয়রানি-কোনো কিছুই যেন বাকি থাকে না।’

ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইনও যাত্রীদের হয়রানি-দুর্ভোগের বিষয়ে সোচ্চার। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের যেসব ভাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকেন, দেশে রেমিটেন্স পাঠান-তাদের বেশি হয়রানি হতে হচ্ছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। একটা মানুষ রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে কষ্ট করে দেশে রেমিটেন্স পাঠান, আর তাকে কোথায় বিমানবন্দরে একটু আতিথিয়েতা দেওয়া হবে উল্টো পদে পদে হয়রানি আর ভোগান্তি উপহার দেওয়া হয়। বিমানবন্দর হলো সেবা সংস্থা। সেখানে কেন যাত্রীকে দুর্ভোগে পড়তে হবে?’

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ:

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিবেদনের পর শাহ আমানত বিমানবন্দর কর্তপক্ষ নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। প্রতিবেদন পাঠানো নিয়ে তখন বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ জানিয়েছিলেন তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্য সংস্থার অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এছাড়া চুরি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি আনসারদের ব্যাপারেও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’

সম্প্রতি হওয়া গণশুনানিতে যাত্রীদের অভিযোগ দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন তাসলিম আহমেদ। জানান ছয় মাস পর পর আনসার সদস্যদের বদলি করা হয়। অন্যায় করলে সাজাও দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে যাত্রীদর সতর্ক হওয়ার আহ্বানও জানান বিমানবন্দরের এই পরিচালক। বলেন, ‘যাত্রীদেরও কিছু অসচেতনা রয়েছে। আমি প্রায় সময় সিসি ক্যামরা দেখি। সেখানে দেখতে পেয়েছি কিছু যাত্রী দুহাতে টাকা ছিটাচ্ছেন। এর সুযোগ নেয় কেউ কেউ। এসব থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

   

হবিগঞ্জে ট্রাকচাপায় পুলিশ সদস্য নিহত



ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, হবিগঞ্জ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় ডিউটিরত অবস্থায় ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন হাইওয়ে থানা পুলিশের কনস্টেবল রবিউল হক (২৫)। বুধবার (২৬ জুন) ভোর সাড়ে ৫টায় শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানার সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জ বিরামচর এলাকায় প্রতিদিনের মতো হাইওয়ে থানার সামনে চেকপোস্ট বসানো হয়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকাগামী একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট-২০-৪৬৬৭) চেকপোস্ট অমান্য করে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবল রবিউল হককে চাপা দেয়। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

নিহত রবিউল হক চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার আলমপুর গ্রামের ছায়দুল হকের ছেলে।

এ সময় ট্রাকচালক চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চাকপাড়া গ্রামের মাজেদ মিয়ার ছেলে কামাল (৫২), একই এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে রমজান (১৮) ও মো. মনিরুল ইসলামকে (২৬) আটক করা হয়।

শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৈমুর ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করছেন।

;

প্রশাসনিক অবহেলা, অবজ্ঞায় সুন্দরবনের মধু ভারতের জিআই পণ্য



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রশাসনিক অবহেলা, অবজ্ঞা, অন্যায়ের ফলে সুন্দরবনের মধু ভারতের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন- ভৌগলিক নির্দেশক) পণ্য হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

বুধবার (২৬ জুন) দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডির সিপিডি সেন্টারে সুন্দরবনের মধু ভারতে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সুন্দরবনের মধু ভারতের চেয়ে ২/৩ গুণ বেশি উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। আমরা যদি মূল উৎপাদনকারী হই, তাহলে ভারত কীভাবে একক উৎপাদনকারী হয়!

অতীতের নির্দেশনা উল্লেখ করে সিপিডির ফেলো বলেন, ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট বাগেরহাটের ডিসি সুন্দরবনের মধুকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তা রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এই দায় আমরা কাকে দেবো! অথচ ভারত আমাদের চার বছর পর ২০২১ সালে আবেদন করে তারা জিআই স্বত্ব পেয়ে গেছে।

ভারতের বাজার অনেক বড় উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে কষ্ট হবে। কারণ, তাদের বাজার অনেক বড়। তাই, তাদের অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়।

এ সময় তিনি আরো বলেন, জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে কিছু লিস্ট করা হয়েছে কিন্তু এটাও কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নয়। সার্ভে করে আমাদের পণ্য যেগুলি আছে, সেগুলি জিআইয়ের অধীনে আনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

ভৌগোলিক পণ্যকে সুরক্ষা দিতে অভিন্ন আইনি কাঠামোতে যেতে হবে জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে থাকা পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা দেবে না। যেমন, বাসমতি চাল এক দেশে সুরক্ষা দেয়নি। এটি ভারত, পাকিস্তানে আছে। সে ক্ষেত্রে লেভেলিং করায় সমস্যা হচ্ছে।

নিজেদের পণ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের সবগুলো পণ্যকে সম্পূর্ণ তালিকাভুক্ত করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ ও পর্যাপ্ত তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এটা খুব দ্রুততার সঙ্গে করা সম্ভব।

এসময় তিনি দেশের জিআই পণ্যকে আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আমাদের জিআই পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। লিসবন-জেনেভা আইনের অধীনে অংশ নিতে হবে।

তিনি বলেন, ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের জন্য এখন সময় এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ব্যবস্থা আত্মস্থ করা। তবে আসল কথা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লাগবে।

বিষয়টিকে অনতিবিলম্ব সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ে আগামী যে কোনো বৈঠকে উত্থাপন করার প্রতি জোর দিয়ে তিনি আরো বলেন, সামনে যদি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন তাহলে সেখানেও এটিকে উত্থাপন করা অবশ্যই উচিত।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুর্বলতর অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেয় আইনি কাঠামো। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তরণকে টেকসই করতে চায়, তাহলে অবশ্যই মেধাস্বত্বকে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত সমাজের দুর্বলতর পিছিয়ে থাকা ব্যক্তিরা।

তিনি বলেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী কোনো জায়গায় বিকশিত হতে পারে না যদি মেধাস্বত্ব সুরক্ষিত করা না হয়! এখন মেধাস্বত্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না যদি মেধাস্বত্ব আইনে সুরক্ষা না থাকে। এটা যে শুধু বিদেশিদের জন্য শুধু তা নয়, বাংলাদেশে হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার আছেন, তাদের সুরক্ষা কী! তাদেরও সুরক্ষা দিতে হবে। নতুন উদ্ভাবকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যও মেধাস্বত্ব সুরক্ষা দিতে হবে।

এসময় আরো বক্তব্য রাখেন- সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান ও সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

;

জার্মানিতে রফতানি হলো ‘হাঁড়িভাঙা আম’



আমিনুল ইসলাম জুয়েল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রংপুরে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া হাঁড়িভাঙা আম জার্মানিতে রফতানি হলো। প্রথম পর্যায়ে ২০০ কেজি আম রফতানি করা হয়েছে। অচিরেই বিভিন্ন দেশে আম রফতানি করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশা কৃষি বিভাগের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে রংপুরের এই জনপ্রিয় হাঁড়িভাঙা আম সরকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন দেশে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ব্রুনাই রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার কারণে হাঁড়িভাঙা আম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুমান ছড়িয়েছে বলে মনে করছেন রংপুরের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২১ জুন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ মাঠে জিআই পণ্য হাঁড়িভাঙা আমের মেলা ও প্রদর্শনী হয়।

এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ। সেখানে তিনি হাঁড়িভাঙা আম রফতানির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মূলত মন্ত্রীর আগ্রহে ঢাকার গ্রিন গ্লোবাল অ্যাগ্রো লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কাওসার আহমেদ স্যাম্পল হিসেবে ২০০ কেজি হাঁড়িভাঙা আম জার্মানিতে পাঠিয়েছেন।

রংপুরে প্রতি বছর জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে পাওয়া যায় স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আঁশহীন সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙা আম। শুরুর দিকে দাম কিছুটা চড়া হলেও হাঁড়িভাঙার স্বাদ নিতে হাট-বাজারে কমতি নেই ক্রেতাদের। এই আম ঘিরে চাষি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। বর্তমানে আকারভেদে প্রতি মণ হাঁড়িভাঙা আম ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বছর প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙার ফলন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে দেড় থেকে দুইশো কোটি টাকার ওপরে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের আমচাষি আমজাদ হোসেন পাইকার বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের ওপরটা যত কালচে, ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ ও মিষ্টি লোভনীয়। দেখতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন আম বাগান কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য কীটনাশক ও স্প্রে ব্যবহার করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর ও পাকা রঙের মনে হয়।

মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাইফুল আবেদীন বলেন, গ্রিন গ্লোবাল অ্যাগ্রো লিমিটেড নিয়মিত বিভিন্ন জাতের আম রফতানি করে আসছে। হাঁড়িভাঙা আমের মেলা ও প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদের আগ্রহে প্রতিষ্ঠানটি জার্মানিতে আম রফতানি করেছে। জার্মানি আরও আম নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জের মো. খলিলুর রহমানের বাগান থেকে ওই আম সরবরাহ করা হয়।

বর্তমানে হাঁড়িভাঙা আম নেপাল ও থাইল্যান্ডে রফতানির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। হাঁড়িভাঙা জিআই পণ্য হয়েছে তা বেশি বেশি করে প্রচার করতে হবে। আম চাষিদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কৃষি অফিস কাজ করছে বলেও জানান সাইফুল আবেদীন।

হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। আঁটিও খুব ছোট। ছোবলা পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০-৩০০ গ্রাম। মূলত জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে হাঁড়িভাঙা আম পরিপক্বতা পায়। বড় সাইজের এক মণ (তিনটিতে এক কেজি) আম পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। মাঝারি সাইজের আম ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। আর ছোট সাইজের এক মণ আম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা।

এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এ আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, চলতি বছর জেলায় ৩ হাজার ৩৫৯ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙার চাষাবাদ করা হয়েছে ১ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে। এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন। শুরুর দিকে প্রতি কেজি আম ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে আমের আকার ও পরিস্থিতির অনেক সময় দামের হেরফের হয়।

;

সুন্দরবনের পাশে কালাবগীর মানুষের ঋণের জালের ফাঁস কতটা জটিল?



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঋণের টাকায় ঘর বানাতে হয়, কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দাদের/ছবি: নূর এ আলম

ঋণের টাকায় ঘর বানাতে হয়, কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দাদের/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ন্যূনতম স্বস্তিদায়ক জীবনযাপন বলতে যা বোঝায় তার সাথে কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার মানুষের কোন পরিচয় নেই। শিবসা ও সুতারখালি নদীর মাঝে পলিমাটি দিয়ে গড়ে ওঠা কালাবগী গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে বাস করে প্রায় ৩০০টি পরিবার যারা কখনই মজবুত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারেনি।

নদীর পাশে এক বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে, বাঁশের উঁচু মাচায় তাদের ঘরবাড়ি এমন ভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে যেন জোড়ালো হাওয়ায় পালকের মতো উড়ে যাবে।

প্রতি বছর, শিবসা নদীর প্রবল জোয়ারের ঢেউ নদী ভাঙনের মাধ্যমে এই পাড়ার ভূগোলই প্রায় পরিবর্তন করে ফেলে। এর ফলে প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা তাদের ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

তাদের জীবনকে দুর্গত করতে প্রতিবছর সাইক্লোন আর জলোচ্ছাস নিয়ম করে তাদের ঘরবাড়ি ও জীবিকা ধ্বংস করে যায়।

ঝুলন্ত পাড়ার দরিদ্র মৎস্যজীবীদের কুঁড়েঘর/ছবি: নূর এ আলম


দরিদ্র মৎস্যজীবীদের তাদের কুঁড়েঘরগুলি পুনর্নির্মাণ করতে হয় ঋণের টাকা দিয়ে। তারা স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তৈরি করে। এছাড়া আর কী বা করতে পারে তারা?  বৃদ্ধ বাবা-মা, শিশু এবং স্ত্রীর জন্য তো মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রয়োজন।

পঞ্চাশ বছর বয়সী মৎস্যজীবী গোলজার সানা বার্তা২৪ কে বলেন যে যতবার তার পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত হয়, ততবার তাকে তার কুঁড়েঘর পুনর্নির্মাণের জন্য একটি ছোট্ট জমি ভাড়া নিতে হয়  জমির মালিককে এককালীন অর্থ দেয়ার মাধ্যমে।

“আমরা যদি আশেপাশের এলাকা থেকে বাঁশ ও গোলপাতার মতো নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহও করি, একটি ঘর পুনরায় তৈরিতে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা লাগে। সমস্ত অর্থই ঋণ হিসেবে জোগাড় করতে হয়,” গোলজার বললেন।

কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার কোনো বাসিন্দাই তাদের বসবাসের বাসস্থানের জন্য জমির মালিক হতে পারেনা। তারা যে ছোট্ট জমিতে ঘর গড়ে বসবাস করে তার জন্য প্রতি বছর কিছু ধনী জমির মালিককে ভাড়া প্রদান করে। সেই জমির মালিকরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ স্থানে যেমন খুলনা শহরে বাস করে। কোন কোন জমির মালিক অবশ্য মহাজন বা ঋণদাতা হয়ে আসেন, যাদের থেকে দরিদ্র মৎস্যজীবীরা উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে তাদের জীবিকা চালায়।

গোলজারের এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে, যারা দাকোপ এলাকায় স্কুল বা কলেজে পড়ছে। তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানো ছাড়াও তাকে তার সন্তানের মাসিক শিক্ষার খরচ দিতে হয় করতে হয় যা জনপ্রতি কমপক্ষে ৩,০০০ টাকা।

আপনি কীভাবে অর্থ জোগাড় করেন? আমরা তাকে প্রশ্ন করি। গোলজার উত্তরে বলেন, “বর্তমানে, আমি ৯০,০০০ টাকা ঋণী। গত বছর, আমার ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০,০০০ টাকা। আমি ২০,০০০ টাকা পরিশোধ করেছি। ৩০,০০০ টাকার দায় ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়  রিমাল (২৬ জুন) আমার ঘর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। একারণে আমি কয়েক সপ্তাহ আগে ৬০,০০০ টাকা ঋণ  করেছি,”।

ছবি: নূর এ আলম

খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায় বাপদাদার বসতভিটা নদীভাঙনে তলিয়ে যাওয়ায় চল্লিশ বছর আগে মাজেদ গাজী কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ায় চলে আসেন। সেই সময়ে, ঝুলন্ত পাড়ায় মাত্র ৩০টি পরিবার ছিল।

বর্তমানে ৫৮ বছর বয়সী মাজেদ কালাবগীতে তার জীবনে অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখেছেন। এ বয়সেও তিনি কিছু ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা যা কালাবগী এলাকার দক্ষিণ প্রান্তের তিন-চতুর্থাংশ ভেঙে নদীতে মিশিয়ে দিয়েছিল। আইলায় তার পরিবার এবং অনেক প্রতিবেশী বাস্তুচ্যুত হয়।

মাজেদ হতাশা নিয়ে বলেন, “আমাদের ঘরদোড় বছরে দুই থেকে তিনবার সরাতে হয় নদীভাঙন বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। এটি একটি নিয়মিত ঘটনা। প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের উপর নতুন করে অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। আমরা এর থেকে বের হতে পারি না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক টাকাও সঞ্চয় করতে পারি না।”

বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৎস্যজীবী হিসেবে কাজ করছে।

ষাট বছর বয়সী শহিদুল গাজীর দুই ছেলেও একই পথ অনুসরণ করেছে। তবে, তার বড় ছেলে আবদুল গাজী নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে।

এখন, শাহিদুল এবং তার স্ত্রী জায়েদা বেগম সম্পূর্ণরূপে তার ছোট ছেলে আলমগীর গাজীর আয়ের উপর নির্ভরশীল। দুই বছর আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে শহিদুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

“খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে আমার ছেলের (আলমগীরের) স্বল্প আয়ে পরিবারের খরচ মেটানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে,” জায়েদা বলেন। সুন্দরবনে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে তার ছেলে বছরে অন্তত পাঁচ মাস আয় করতে পারে না ।

যখন সুন্দরবনে মাছ ধরার পাশ দেওয়া হয়, তখন আলমগীর দিনে ৫০০-১,০০০ টাকা আয় করতে পারে। তবে, আয়ের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়।

“একারণে টিকে থাকতে আমাদের সারা বছর ঋণ নিতে হয়,” জায়েদা বললেন। বর্তমানে, পরিবারটির ৫০,০০০ টাকা ঋণ রয়েছে, যার মধ্যে গত বছরের দায় ৩০,০০০ টাকা অন্তর্ভুক্ত।

যখন জায়েদা তার ঝুলন্ত কুঁড়েঘরে কথা বলছিলেন, তখন নির্বাক শহিদুল তার স্ত্রীর দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি নিমাই কুমার রায় বার্তা২৪ কে বলেন যে এই ঝুলন্ত পাড়া গ্রামের মানুষরা নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে।

“এখানে বিকল্প আয়ের কোন উপায় নেই যে তারা দুর্যোগে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। তাদের ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়ারও কোন উপায় নেই। পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক সরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের এই অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব,” নিমাই বলেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খান মেহেদি হাসান দেখেছেন যে কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার মৎস্যজীবীদের জন্য অর্থের প্রবাহ প্রয়োজন, বিশেষ করে মাছ শিকারের এবং নিয়মিত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্য। এই অর্থের জন্যই তারা স্থানীয় মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন।

“যদি তাদেরকে ঋণের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করতে হয় তাহলে সরকারকে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে সনাক্ত করে তাদের জীবিকা যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকে তার জন্য অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে,” অধ্যাপক খান উপসংহারে বলেন।

;