‘রাজাকার’ স্লোগান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, বলছেন বিশিষ্টজনরা

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকাররা যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী নিজেদের ‘রাজাকার’ পরিচয় দিয়ে স্লোগান দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে একে অনাকাঙ্খিত ও অগ্রহণযোগ্য বলেছেন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনরা। এই স্লোগানকে 'রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার অংশ' বলেও অভিহিত করেন তারা।

শিক্ষার্থীরা কোনো স্বার্থবাদী মহলের উষ্কানিতে এমনটা করছে বলেই মত তাদের। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে’ এমন দাবিতে রোববার মাঝরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’, ‘রাজাকার আসছে রাজপথ কাঁপছে’, ‘ঢাবিতে হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’- এমন সব স্লোগান দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

দিনভর এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা ও উত্তেজনার মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের স্লোগান নিয়ে বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে কথা বলেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী

‘এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’

কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের স্লোগানে নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে উচ্চারণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক, নিন্দনীয়। আমরা সবাই এই ঘটনার জন্য লজ্জিত ও অপমানিত।

এ ধরণের ঘটনা ঘটবে বা ঘটতে পারে তা চিন্তার বাইরে।' "এ ধরণের স্লোগান বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার, আলদবর, আল শামস-যাদের নামের সঙ্গেই যুক্ত আছে হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগকারী-এই শব্দগুলো। একাত্তরে রাজাকাররাই পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো করেছে। তাদের নাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে স্লোগান দেওয়া এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দেশে অকল্পনীয়। গর্হিত অপরাধ। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের শামিল," বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।

আন্দোলনকারীরা এই স্লোগানের মাধ্যমে সরকার নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এর সঙ্গে সরকার বা উচ্চ আদালতের কোন মতপার্থক্য আছে। আন্দোলনকারীরা চাচ্ছে কোটা সংস্কার। সরকার ২০১৮ সালে কোটা বাদই দিয়েছিল। তারপর এটা আদালতে পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করা হয়েছিল। মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ আদালত উন্মূক্ত আছে। তারা যেকোন সময় তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারে। এখানে আমি কোন বিরোধ দেখি না।’

‘বিরোধ যদি কিছু থাকে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। যদি সমাধান নাও হয় সেখানে আন্দোলনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া, সরকারের সমালোচনা করা তা তাদের আন্দোলনের অংশ-সেটাও তারা করতে পারে। কিন্তু তারা যে কাজটি করেছে তা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়।’

ড. আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, ‘যে রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত। সেই রাষ্ট্রের ভিতরে থেকে এ ধরণের স্লোগান দেওয়া...এটা আমাদের স্তম্ভিত করেছে। হতবাক করেছে। বাকরুদ্ধ করেছে। আমি নিজে এই ঘটনার যে নিন্দা জানাব সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে মনে করেন সাবেক এই উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমি যেটা বুঝতে পারি তরুণরা তাদের চাকুরির সংস্থানের জন্য নানাভাবে চিন্তিত। সেজন্য তারা এই আন্দোলনে গেছে। কিন্তু তাদেরকে কাজে লাগিয়ে, অপব্যবহার করে পেছনে কোন ষড়যন্ত্রকারীর চক্রান্তকারী এই উষ্কানিমূলক কাজটি করিয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি আন্দোলনকারী সকল শিক্ষার্থী এই শ্লোগান দেয়নি। এই স্লোগান দিয়েছে অল্প কিছু ছেলেমেয়ে যারা পেছনে থেকে ফায়দা লুঠতে চায় তাদের ইন্ধনে এ কাজগুলো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই আমি দেখি।’

‘ঘোরপ্যাঁচ করে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল না’

কোটা আন্দোলন ধীরে ধীরে ভিন্ন চরিত্র লাভ করতে দেওয়া দরকার ছিল না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী।

বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘উপরের দিকটা দেখলেই হবে না। অনেক গভীর থেকে দেখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটু ইমোশনাললি কথা বলেছেন, তিনি তো মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন। তার পরিবারের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তার ছোট ২ ভাই মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতার কন্যা তিনি। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে কথা উঠবে তখন তাঁর মাঝে ইমোশনাল আউটবার্স্ট হতেই পারে। সেই আউটবার্স্টকে এমনভাবে টেনে নিয়ে গেছে...। তখন তারাও (শিক্ষার্থীরা) আউটবার্স্ট করেছে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার’.. এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

‘আমি সেই সঙ্গে এও বলব কোটা সংস্কার করা যৌক্তিক দাবি। এটাকে ঘোরপ্যাঁচ করে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল না। এখনও আমি মনে করি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা হয়, তারা সরে না আসলেও আন্দোলন স্তিমিত হবে। কিন্তু সেটা না হয়ে আজকে যে মারপিট হলো সেটা খারাপ হলো’-যোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।

আন্দোলন বিস্ফোরণ উন্মূখ হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা দেখেন কিনা এমন প্রশ্নে এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘সমস্যা শুরুতেই প্রশমনের উদ্যোগ নিতে হয়। এটা শুরুতেই নিরসন করে দেওয়া যেত। তারা তো বেশি কিছু চায়নি। তারা তো বলেছিল একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটা বলা হোক। সিদ্ধান্তটা আসতে হবে নির্বাহী বিভাগ থেকে, বিচারবিভাগ থেকে নয়।’

এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, বিষয়টিকে কিছুটা গুরুত্বহীন মনে করা হতে পারে। গুরুত্বহীন মনে করা খারাপ। অনেক সময় ছোট ঘটনাও বড় আকার ধারণ করে। এখনো সময় আছে মনে হয়।’

‘এর পেছনে ইতিহাস বিমুখতা’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের বিষয়ে বলেন, ‘রাজাকারকে নিজেদের আত্মপরিচয় দিয়ে যে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে তা অনাকাঙ্খিত। আমরা বিস্মিত! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতির ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের সুতিকাগার ছিল, পাকিস্তান আর্মির ক্ষোভের কারণ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। যার প্রকাশ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমরা দেখেছি।’

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার-আলবদররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ধরে নিয়ে নৃশংস্যভাবে হত্যা করেছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজাকারকে নিজের আত্মপরিচয় দিয়ে স্লোগান উঠবে, এটা আমরা কখনো ভাবিনি। আমরা মনে করি, এটা আমাদের চেতনাহীনতাকে প্রমাণ করে।’

যারা এই স্লোগান দিয়েছেন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবেন আশা করে গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘যেকোন আন্দোলনে নানা মত থাকতে পারে। যে কোন দল, ব্যক্তি বা সংগঠনই আন্দোলন করতে পারেন। কিন্তু কখনোই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি যারা একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত তাদেরকে নিজেদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড় করিয়ে স্লোগান দেওয়াটা কখনো স্বাভাবিক হতে পারে না। এর পেছনে রয়েছে আমাদের জাতি হিসাবে আত্মবিস্মৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে বিমুখতা।’

‘আমরা আমাদের প্রজন্মকে একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের সংস্কৃতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় থেকে বেরুতে পারার সুযোগ নেই’-যোগ করেন এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।