অস্তিত্ব সংকটে নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দির

  • সোহেল মিয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজবাড়ী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দির

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দির

যে জোড় বাংলা মন্দিরকে ঘিরে এক সময়ে গড়ে উঠেছিল আটটি মন্দির, সেই মন্দির আজ জৌলুস হারাতে বসেছে। অবৈধ দখলদার আর সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে পৌনে চারশত বছর আগে স্থাপিত রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দির। ইতিহাসের পাতায় জোড় বাংলা মন্দিরটি এখন শুধুই স্মৃতি। কোন রকম ভগ্ন স্তুপে দাঁড়িয়ে আগামী প্রজন্মকে জানান দিচ্ছে তার সোনালী দিনের স্মৃতি। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যেটুকু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে তাও জরাজীর্ণ ও লতাপাতায় ভরা।

জানা যায়, ১৬৫৫ সালে উড়িষ্যার গৌরীয় রীতিতে রাজা সীতারাম রায় এই জোড় বাংলা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে শ্রী কৃঞ্চ রাম চক্রবর্তী রাজা সীতারাম রায়ের অনুরোধে নলিয়া গ্রামে এসে দেব মন্দির এবং বিগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নলিয়ায় জোড় বাংলা মন্দিরের পাশে অবস্থিত দুটি মন্দির। একটি মন্দিরের চূড়া থাকলেও অপরটির চূড়া অবশিষ্ট নেই। এই জোড় বাংলা মন্দিরকে ঘিরেই এখানে এক সময় নির্মিত হয় ৮টি মন্দির।
এই মন্দির কিভাবে স্থাপিত হলো তা নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তবে জনশ্রুতি রয়েছে, ১৬৫৫ সালে রাজা সীতারাম রায় তৎকালীন সময়ে রাজবাড়ির বেলগাছিতে সোনা দিয়ে নির্মিত একটি মূর্তি দিয়ে পূজা করতে চেয়েছিলেন। রাজার ইচ্ছাপূরণে সে সময়ে সোনা দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজটি নলিয়া গ্রামের জনৈক এক কর্মকারকে দিয়ে করানোর নির্দেশ দেন। কর্মকার মূর্তি তৈরির জন্য রাজার কাছে সোনা চাইলে রাজা বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখেন। কর্মকার স্বর্ণ চুরি করতে পারে ভেবে রাজা তার নিজ বাড়িতে কর্মকারকে ডেকে সেখানে মূর্তি তৈরি করতে বলেন। রাজার এমন মনোভাবে কষ্ট পান কর্মকার। তিনি রাজার বাড়িতে বসেই সোনার মূর্তির পাশাপাশি অনুরূপ আরেকটি মূর্তি তৈরি করেন পিতলের।


কিন্তু সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী একই মন্দিরে দুই পূজা না করার বিধান থাকায় কর্মকার পূজা শুরুর আগে রাজার অনুমতিক্রমে সোনা ও পিতলের তৈরি দুটি মূর্তির কথা স্বীকার করেন। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তখন রাজা পিতলের তৈরি মূর্তিটি নিয়ে কর্মকারের বাড়ি নলিয়াতে স্থাপন করে সেখানে পূজা করার নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে রাজা সেখানে একটি মন্দিরও নির্মাণ করে দেন। তখন থেকেই এর নাম হয় নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির। এরপর সেখানে রাজা আরো ৮টি মন্দির স্থাপন করে দেন।

কালের আর্বতনে আজ ঐতিহ্যবাহী এই নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটি অবহেলা আর অযত্নে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরটি লতাপাতায় ভরে রয়েছে। মন্দিরের গায়ের থেকে ইট খুলে পড়ছে। মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। মন্দিরটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে শতশত বছরে ইতিহাসের সাক্ষী এই জোড় বাংলা মন্দিরটি। মন্দিরটির ৩১ শতাংশ জমি রয়েছে। সেই জমির বেশির ভাগই এখন বেদখলে বলে দাবি মন্দির কর্তৃপক্ষের। মন্দিরটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। মন্দিরের ভেতরে বাস করছে চামচিকাসহ বিভিন্ন প্রাণী।

মন্দিরটির দ্রুত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়ে মন্দির দেখতে আসা দর্শনার্থী ফরিদপুরের বোয়ালমারির বাসিন্দা প্রভাষক বিপুল কুমার মন্ডল বলেন, সনাতন ধর্মাম্বলীদের কাছে এটি পবিত্র স্থান। এটি শতশত বছরের ইতিহাসের একটি অংশ। মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে আগামী প্রজন্মকে ইতিহাস জানার থেকে দূরে রাখা। তিনি এটিকে দ্রুত সংস্কার করে জোড় বাংলা মন্দিরটিকে রক্ষা করার জোড় দাবি জানান সংশ্লিষ্টদের প্রতি।


মন্দিরের সেবায়েত বিদ্যুৎ কুমার মুখার্জী জানান, ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দিরটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থী ছুটে আসেন। এখানে আসার পর মন্দিরটির এই করুণদশা দেখে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যান। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঐতিহ্যবাহী নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটি দ্রুত সংস্কার না করলে অচিরেই মন্দিরটি তার অস্তিত্ব হারাবে।

জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ফরিদ হোসেন বাবু বার্তা২৪.কমকে জানান, বালিয়াকান্দিতে হাতেগোনা কয়েকটি ইতিহাস-ঐতিহ্যবহনকারী স্থাপনা রয়েছে। তার মধ্যে নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটি অন্যতম। মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার পরিষদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এসে পরিদর্শন করেই শুধু চলে যান। কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না।

মন্দিরটির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বার্তা২৪.কমকে জানান, চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে চার সদস্যের একটি দল মন্দিরটি পরিদর্শন করেছেন। মন্দিরটি এখনো সংরক্ষিত হয়নি। সংরক্ষণের কাজ চলমান। সংরক্ষণ হওয়ার পরই শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটির সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।