চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ক্ষতের দাগ

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফলকের বর্তমান চিত্র/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

ফলকের বর্তমান চিত্র/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার সঙ্গে বেতারের জড়িয়ে থাকা সেই স্মৃতি ধরে রাখতে বহদ্দারহাট মোড়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ’ শীর্ষক ভার্স্কয। গত ৭ মার্চ সেটি উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।

উদ্বোধনের পর থেকে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল কাচ ঘেরা পিরামিড আকৃতির ফলকটি। কিন্তু চার মাসের মাথায় সেই স্মৃতিফলকটি যেন এখন নিজেই স্মৃতি! গত ১৮ জুলাই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা সেই ফলকটি ভেঙে চুরমার করে দেন।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় ফলকটিকে তছনছ দেখে থমকে দাঁড়ান সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক সাহাব উদ্দিন। ফলকটির কি অপরাধ ছিল-নিজের কাছে নিজেই সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে এই চালক বলতে শুরু করেন, ছাত্রদের আন্দোলন আর কারফিউর কারণে পাঁচদিন ঘরে বসা ছিলাম। বুধবার দুপুর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলেও বহদ্দারহাটের দিকে আসা হয়নি। আগে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় নিয়মিত চোখ যেত ফলকটির দিকে। কিন্তু আজ সেই ফলকটির এমন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শীর্ষক ভার্স্কয

ফলকটির চারপাশের কোনো কাচই আর অক্ষত নেই। তবে কাচের ফ্রেমের ভেতর বসানো মাইক্রোফোন আকৃতির প্রতীকটিতে তেমন একটা দাগ লাগেনি। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের সময় যে মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হয়েছে তারিই প্রতীক হিসেবে কাচের ভেতর এটি বসানো হয়েছিল। আর পিরামিড আকৃতির ফলকটি নির্মাণের কারণ ছিল-মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কিনা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই ফলকটিই ভেঙে দিলেন।

মূল শহরের পূর্ব প্রান্তে পড়েছে বহদ্দারহাট। ফলে আন্দোলন কিংবা সংঘাত এই এলাকায় খুব কমই হতো। কিন্তু সেই এলাকাটি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে পুলিশ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ১৮ ও ১৯ জুলাই টানা দুদিন উত্তপ্ত ছিল। এখানে সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন তিনজন।

সংঘর্ষের পর থেকে বহদ্দারহাটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরেও পুলিশের উপস্থিতি ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।

১৮ জুলাইয়ের সংঘর্ষে শুধু ফলক নয়, বহদ্দারহাট মোড়ে থাকা পুলিশ বক্সটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চার কক্ষের এই ফাঁড়িতে চান্দগাঁও থানার একজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে একটি টিম ও একজন সার্জেন্টের নেতৃত্বে ট্রাফিক পুলিশের একটি দল নিয়মিত অবস্থান করে আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতেন। এখন ফাঁড়িটি পুড়িয়ে দেওয়ায় তারা সেখানে আর বসতে পারছেন না।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গেটে তালা ঝুলছে। ফাঁড়ির সদর দরজাটিও বন্ধ। এক তলা ভবনজুড়ে পোড়ার ক্ষত, কালো দাগ। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় এই ফাঁড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফাঁড়ির সামনে রাখা তিনটি মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয় সেদিন। আগুনে ফাঁড়ির ভেতরের সব জিনিস ও ফাইলপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ফাঁড়ির বাইরে পুলিশ সদস্যরা থাকলেও তারা এই বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এর আগে ২০১২ সালেও এই ফাঁড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় উত্তেজিত জনতা পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়, আগুন দেয়। ওই ঘটনার পর পুলিশ ফাঁড়িটি এক তলা ভবনে নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। এবার আগুনে আরেকবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই পুলিশ বক্সটি।

পুড়ে যাওয়া পুলিশ বক্স


সংঘর্ষের কারণে ও কারফিউ জারি থাকায় বহদ্দারহাটের ব্যবসায়ীরা বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সংঘর্ষের সময় বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় প্রায় দুদিন অন্ধকারেই বেচাবিক্রি করতে হয়েছে বিক্রেতাদের। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আগের মতো ক্রেতা নেই সেখানে। গত তিনদিন ধরে দিনের বেলায় বেশিরভাগ দোকান খুললেও কারফিউর কারণে সন্ধ্যার পর প্রায় দোকানই বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের প্রবেশমুখে ফলের দোকানিরা বসেন। বেশ কয়েকদিন দোকান বন্ধ থাকায় তাদের অনেক ফলই পচে নষ্ট হয়ে যায়। ফল দোকানি আবদুর রশিদ বলেন, ১৮ জুলাই সংঘর্ষ শুরু হলে কোনোমতে জান নিয়ে পালাই। ভেবেছিলাম দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু পরদিন আবারও ঝামেলা হয়। এরপর তো কারফিউ শুরু হলো। সেজন্য আর দোকানমুখী হতে পারিনি। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে এসে দেখি-বেশিরভাগ আমই পচে গেছে। বহু টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে গেলাম।

একই কথা বললেন আরেক ফল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোহেলও। তার দোকানেরও প্রায় সব ফল নষ্ট হয়ে গেছে। সোহেল বলেন, পচা ফলগুলো ফেলে দিয়ে বুধবার নতুন ফল দোকানে তুললাম। এখন আল্লাহ আল্লাহ করছি-পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে। কেন না দোকান না খুললে তো আমাদের পেটে ভাত পড়বে না।

আশপাশের মানুষেরাও সাঁয় দেন সোহেলের কথায়। বলেন, ‘পেট তো আর আন্দোলন বুঝবে না, বুঝবে না কারফিউ। যত কিছুই হোক-তার তো তিন বেলা খাবার লাগবেই…’