বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের কী দোষ ছিল

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’ ম্যুরাল

‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’ ম্যুরাল

লাখো মানুষের সামনে উঁচিয়ে ধরেছেন তর্জনী। আর মুখে সেই অমর ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়কের সেই ঐতিহাসিক তর্জনী উঁচিয়ে ধরার মুহূর্তকে টেম্পার গ্লাসে খোদাই করে চট্টগ্রামের জামালখানে স্থাপন করা হয়েছিল ম্যুরাল।

সাড়ে চার বছর আগে উদ্বোধন করা ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’ নামের সেই ম্যুরাল আর অক্ষত নেই। গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের একটি মিছিল থেকে দুর্বৃত্তরা এই ম্যুরালটি ভেঙে দিয়েছেন। এখন সেই ম্যুরালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়ান মানুষ। বিস্ময়ে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন ছোঁড়েন-এই ম্যুরালটির কি দোষ ছিল?

বিজ্ঞাপন

জামালখানের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে সিনিয়রস ক্লাবের মাঝ বরাবর দেয়ালে এই ম্যুরালটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শিল্পী প্রণব সরকারের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবি বিশেষ প্রক্রিয়ায় খোদাই করে তৈরি এই ম্যুরালটি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়।

এই ম্যুরালের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। আর সেটি উদ্বোধন করেছিলেন তখনকার সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ৪ ফুটের আটটি উন্নতমানের টেম্পার গ্লাস ব্যবহার করে তৈরি এই ম্যুরালটিতে প্রথমে ১০ মিমি টেম্পার গ্লাসে বঙ্গবন্ধুর ছবি খোদাই করা হয়েছে। আরেকটি ১০ মিমি টেম্পার গ্লাস খোদাই করা গ্লাসটির পেছনে স্যান্ডউইচ (জুড়ে দেওয়া) করা হয়েছে। পাশেই আরেকটি কাচে লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী। ভূমিকম্প বা অন্য কোনো কারণে ঝাঁকুনি হলে টেম্পার গ্লাস যাতে ভেঙে না যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় অ্যাঙ্গেল, রাবার ইত্যাদির প্রটেকশন দিয়ে চূড়ান্তভাবে স্থাপন করা হয়েছিল ম্যুরালটি। তাই বোঝায় যাচ্ছে শক্ত কোনো জিনিসের আঘাত করা হয়েছে এই ম্যুরালে।

বিজ্ঞাপন

সেই অভিযোগ তুলেছেন এই ম্যুরালের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারী জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনও। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ম্যুরালটি বেশ শক্ত কাচের ওপরেই খোদাই করা হয়েছিল। দেশে টেম্পার গ্লাসের ওপর এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ম্যুরাল। এতে কোনো লাঠিসোঁটার আঘাত করা হয়নি। পরিকল্পনা করেই লোহাজাতীয় কিছু দিয়ে ম্যুরালটিতে আঘাত করা হয়েছে। যাতে ভেঙে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে মিছিল নিয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের একটি মিছিল জামালখান হয়ে কাজির দেউড়ি জিইসির দিকে যায়। সেই মিছিল জামালখানে আসতেই কয়েকজন ম্যুরালটিতে আঘাত করেন। এতে ম্যুরালের বঙ্গবন্ধুর মুখ ও হাতের মাঝখানের এবং মাথার পেছনের কিছু অংশ ভেঙে যায়। তবে আঘাতে পুরো ম্যুরালটিই ভেতরে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার কারণে পরবর্তীতে সেই ক্ষতচিহ্ন আরও বড় হয়ে গেছে।

জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু যে আরও শক্তিশালী সেটি আরও একবার প্রমাণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। তিনি বলেন, ওরা বঙ্গবন্ধুকে ভয় পায়। সেজন্য বারবার তার ম্যুরালের ওপর হামলা চালায়। আমরা আবারও ম্যুরালটিকে আগের জায়গায় নিয়ে আসব। শিগগির কাজ শুরু হবে। আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের দিন যাতে সেটি উদ্বোধন করা যায় সেই পরিকল্পনা আমাদের আছে।

ভেঙে দেওয়া এই ম্যুরাল এলাকা পরিদর্শন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরিদর্শনের পর ম্যুরালটিকে এই অবস্থায় দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ বলেন, এর আগেও জামালখানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের ওপর আঘাত করা হয়েছিল। এবারের ঘটনায় জড়িতদের ধরে উপযুক্ত বিচার করা হোক-এটাই আমাদের দাবি।

শনিবার (২৭ জুলাই) দুপুরে জামালখান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে যাওয়া ম্যুরালের নিচে পড়ে রয়েছে কাচের টুকরো। এই পথ ধরে চলতে গিয়ে সেই ভাঙা ম্যুরাল দেখে কয়েক মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়াচ্ছেন শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকেরা। কেউ কেউ নিজের মোবাইল ফোনে সেই ম্যুরালের ছবি তুলে রাখছেন।

১২-১৩ বছরের এক কিশোর নিজের কম দামি মোবাইল ফোনে ম্যুরালটির ছবি তুলছিল। জানতে চাইলে সে বলে, ম্যুরালটি দেখতে ভালো লাগতো। বইয়ের পাতায় পড়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। এটাকে এভাবে ভেঙে দিল কেন?

আরেকজন নারী অভিভাবক যাওয়ার সময় তার শিশুকন্যাকে ম্যুরালটি সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ম্যুরালটিকে এভাবে দেখে হৃদয়ে আঘাত পেলাম। আশা করব যারা এই ন্যাক্কারজনক কাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিচার হবে।