‘আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে কোথায় যাব, বানের জলে সব ভাইসা গেছে’

  বন্যা পরিস্থিতি
  • মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বন্যাকবলিত এলাকার পানি কমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসিদের

বন্যাকবলিত এলাকার পানি কমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসিদের

‘আশ্রয় নিয়েছি অন্যজনের ঘরে। তারা কতদিন রাখবে? আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাবোই বা কোথায়? ঘরের সব শেষ হইয়া গেছে বানের জলে।’

চরম অসহায়ত্বের সাথে কথাগুলো বলছিলেন, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামের বাসিন্দা মাসুদা বেগম। অর্থের অভাবে অন্যজন থেকে ঘরের আসবাবপত্র কিনে ঘর সাজিয়েছিলেন। শখ করে কিনেছিলেন কিছু নতুন জিনিসপত্র। মেয়ের বিয়ের জন্য জোগাড় করেছিলেন নতুন সম্পদ। ছেলে-মেয়ে স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার। স্বপ্ন দেখছিলেন সুন্দর ভবিষ্যতের। কিন্তু বছর দুই না পেরুতেই নিমিষেই তার সব শেষ হয়ে গেছে বানের জলে। তিলে তিলে গড়া সংসার চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

টানা বৃষ্টি এবং ভারতের উজানের পানির স্রোতে মুহুরী-কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে সমগ্র ফেনী। যে এলাকায় কখনও বন্যা হয়নি, সে এলাকাও প্লাবিত হয় বন্যার পানিতে। সে বন্যায় প্লাবিত হয়ে চোখের সামনে শেষ হয়ে গেছে মাসুদা বেগমের স্বপ্ন। বানের জলে ভেসে গেছে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার। নষ্ট হয়ে গেছে ঘরের সকল আসবাবপত্র। বন্যার পানি থেকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের বাড়ির একটি তিনতলা ঘরে। বন্যার পানি নেমে গেলেও মাসুদা বেগমের ঘরে থাকার উপক্রম নেই। বার্তা২৪.কমকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাই বলে উঠলেন, ‘পানি কমে গেলেও যাব কোথায়, ঘরের তো সব শেষ।’

বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে ঘরের সব আসবাবপত্র

মাসুদা বেগম বলেন, বন্যার পানিতে কিছু বের করতে পারিনি। ঘরের খাট, সোপা, আলমিরা, হাড়ি পাতিল ফ্রিজ সব পানিতে শেষ হয়ে গেছে। ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না। মেয়ে, ছেলের বউ এবং নাতনিদের নিয়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। ঘরের ছাল পর্যন্ত পানি ছিল। সব ধ্বংস হতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি, কিছু করার ছিল না। সব পানিতে ভেসে ভেসে চলে গেছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সামর্থ্য আমার নেই। ঘরে থাকার মতো অবস্থা ও নেই। সম্পূর্ণ ঘর নিচের দিকে ঢেবে গেছে। এসময় তিনি ঘর পুনর্নির্মাণ করতে সরকার এবং বৃত্তশালীদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

একই বাড়ির আরেক বাসিন্দা আলী হোসেন৷ ৫ দিন আগেও যার ঘর ছিল আসবাপত্রে সাজানো গোছানো সে ঘর যেন এখন একটি কাদার গোড়াউন। ফেনীর ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় সব কিছু হারিয়ে পাগল প্রায় তিনি। সাজানো গোছানো সংসারের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।বন্যার পানিতে ঘরের ফ্রিজ, সোপা, ছেলেমেয়েদের বইখাতাসহ ঘরে গচ্ছিত ধান-চাল সব তলিয়ে গেছে। ঘরের ছাল পর্যন্ত ডুবে যাওয়া এ ঘরে ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকার কোনো উপক্রম নেই তার।

আলী হোসেন বলছেন, জীবদ্দশায় তিনি এমন বন্যার পানি কখনও দেখেননি। বন্যা কবলিত এলাকা না হওয়াতে কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। ফলে যা হওয়ার, তাই হলো। বন্যার পানি থেকে কিছু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।

বার্তা২৪.কম-কে তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে আরেক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। তবে ঘরের কিছুই বাঁচাতে পারিনি। ঘরের মধ্যে গলা সমান পানি ছিল। ঘরের ফ্রিজ, আসবাবপত্র সব পানিতে ভেসে গেছে। চোখের সামনে সবকিছু নষ্ট হতে দেখেছি, তবে কিছুই কর‍তে পারলাম না। ছেলের স্বল্প রুজি, আর নিজে চাষাবাদ করে সংসার চালাতাম, এখন নিজে কীভাবে চলব, কী খাব আর কোথায় থাকব, নিজেও জানি না। নিজের জমির ধানও নষ্ট হয়ে গেছে, বর্গা নেয়া জমির ধান ও শেষ। আগামী বছর কী খাব তারও ঠিক নেই। আমাকে যদি একটু সহযোগিতা করে আমি পরিবার নিয়ে চলতে পারতাম। অন্যথায় ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে।

মাসুদা বেগম ও আলী হোসেনের মত অবস্থা জেলা জুড়ে। বন্যার পানির তীব্র স্রোতের বিপরীতে তিনদিন টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন সাধারণ মানুষ। এখনও তাদের চোখে মুখে তাদের আতঙ্কের ছাপ।

তারা জানান, পানিতে টিকতে না পেরে একপর্যায়ে অন্যজনের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর খাবার পান। তবে ঘরের কোনো আসবাবপত্রই নিয়ে যেতে পারেননি। শখের টিভি, ফ্রিজ সব পানিতে ডুবে একাকার হয়ে পড়ে।

রেহানা বেগম নামে লাঙ্গলমোড়া গ্রামের একজন বলেন, দুই বছরের ধান ঘরে রেখেছিলাম। সব পানিতে ভিজে শেষ। পানিতে ভিজতে ভিজতে ধানের চারা চলে এসেছে। এমন অবস্থা আমার জীবনে আমি আর দেখিনি। ছেলেমেয়েদের বই খাতা থেকে শুরু করে ঘরের কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘরের মধ্যে ঢুকলে মনে হচ্ছে- কোনো ফসলি জমিতে আছি, এরমধ্যে সাপের ভয় আছে। বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে ঘরের ভেতর। কীভাবে সব ঠিক করব, এ শোক কীভাবে কাটাব আমার কোনো ধারণা নেই।

তিনি বলেন, দুইদিন ত্রাণের শুকনো খাবার খেয়ে আছি। আশ্রয় নিতে পিএইচপিতে গিয়েছিলাম। সেখানে দু’দিন থেকে এখানে আসার পর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমার স্বামী এ অবস্থা দেখে স্ট্রোক করার উপক্রম হয়ে গেছে। নিজেরা কি খাব, ছেলে-মেয়েদের কী খাওয়াব, সে চিন্তায় দিন পার করছি।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এমন অবস্থায় আছেন প্রতিটি মানুষ। কারও ফসলি জমি, কারও মাছের ঘের কারও ঘরবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সবকিছু পানিতে তলিয়ে বিভীষিকাময় দিন পার করছে গ্রামের মানুষ। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।