না, জাতীয় সংগীত বদলাবে না!

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’ তুমুল হৃদয়স্পর্শী এ গানের প্রথম দশ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ। ১৯৭২ সালের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে হুট করে ‘আমার সোনার বাংলা’-কে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হয়নি। এর চর্চা ছিল দীর্ঘদিন, ছিল সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও ছিল এর স্বীকৃতি। একাত্তরের পাকিস্তানিদের পরাস্ত করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে মুক্তিযোদ্ধারা যে মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি-প্রশিক্ষণ নিতেন সেখানে গাওয়া হতো এই গান, দেশবাসীকে উজ্জীবিত করতে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো এই গান। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভায় গাওয়া হতো এই সংগীত। জনসভায় গাওয়া হতো এই গান। এটা কেবল একাত্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর আগে থেকেও এই গানের চর্চা ছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার মন্ত্রে বাঙালিদের উজ্জীবিত করতে।

বিজ্ঞাপন

‘আমার সোনার বাংলা’-কে জাতীয় সংগীত রূপে নির্ধারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক সিদ্ধান্তের বিষয় যে ছিল না, সেটা উল্লিখিত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে। একটা গানকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের এমন এক মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার উদাহরণ এবং স্বদেশপ্রেমের চর্চার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত রূপে এর স্বীকৃতি তাই ছিল তৎকালীন সরকারের সহজ সিদ্ধান্ত।

তবে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট ধানমন্ডির বত্রিশের বিয়োগান্তক ঘটনায় যখন দৃশ্যপটে চলে আসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তখন তিনি অন্য কিছু বদলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংগীতকেও বদলে ফেলার উদ্যোগ নেন। করে ফেলেন উচ্চ পর্যায়ের এক কমিটি, যেখানে প্রধান করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিতর্কিত ভূমিকায় থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক দ্বীন মুহাম্মদকে। জানা যাচ্ছে, এই কমিটি নাকি তিনটি বৈঠক করে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতাকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে। এরপর ক্ষমতা দখলের উত্তুঙ্গু পরিস্থিতিতে মোশতাকই ক্ষমতাচ্যুত হন, বদলায়নি দেশের জাতীয় সংগীত।

বিজ্ঞাপন

খন্দকার মোশতাকের যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু করেন জিয়াউর রহমান। তার আমলে ফের জাতীয় সংগীত বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময় ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। এনিয়ে নিয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন। চিঠির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এরপর জিয়াউর রহমানের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি এই গান গাওয়া শুরু হয়। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলেনি।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পরের উদ্যোগ ফের জিয়াউর রহমানের দল পরের পর্বের বিএনপির শাসনামলে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০২ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধের দায়ে পরবর্তীতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা, তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্যে যৌথ সুপারিশপত্র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেন। খালেদা জিয়াও জামায়াতের দুই মন্ত্রীর সুপারিশকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। বিষয়টি তাদের মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে এটা পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এরপর অবশ্য এটা চাপা পড়ে যায়, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদলগুলো আন্দোলনে উত্তুঙ্গু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।

এবার ফের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ওঠেছে। এবার এখন পর্যন্ত অবশ্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই দাবি ওঠেনি। দাবি করেছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। গত ৩ সেপ্টেম্বর আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহিদের প্রকৃত সংখ্যা ও জাতীয় সংগীতের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। তার দাবি, বর্তমানে যে জাতীয় সংগীত চলছে, তা করেছিল ভারত। দুই বাংলাকে একত্র করার জন্য করা হয়েছিল এই জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নতুনভাবে হওয়া উচিত। আমান আযমীর ভাষ্যমতে, জাতীয় সংগীত করার জন্য অনেক গান রয়েছে। এই সরকারের উচিত, নতুন কমিশন গঠন করে একটি নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা।

আমান আযমী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনসম্মুখে এসেছেন। দাবি করেছেন, তিনি ‘আয়নাঘর’ নামের এক বন্দিশালায় বন্দি ছিলেন। তার প্রতি হাসিনা-সরকার অনেক অন্যায় করেছে। তার পিতৃপরিচয়ের কারণে তার প্রতি এমন অন্যায় করা হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। জাতীয় সংগীতের পরিবর্তনের দাবির সঙ্গে সঙ্গে আমান আযমী এবারই প্রথম যে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এমন না; এরআগে ২০১৫ সালের মার্চেও মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের সংখ্যা তার ভাষায় ‘কাল্পনিক’। তিনি বাহাত্তরের সংবিধান বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিও করেছেন। তার দাবি, ‘শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহিদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’

আমান আযমীর এই মন্তব্য, দাবি ও মন্তব্য বিক্ষুব্ধ করেছে দেশবাসীকে। অনেকেই প্রতিবাদী হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টাইমলাইন-টাইমলাইনে শোভা পাচ্ছে জাতীয় সংগীতের লাইনগুলো, জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদের ফটোকার্ডে সয়লাব সামাজিক মাধ্যম। দেশের একাধিক জায়গায় ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ গাওয়ার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবারের কোন কর্মসূচি পালিত হয়নি। রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ গাওয়ার যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল, তা স্থগিতের কারণ জানিয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে এর আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুমান আহমাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরা কর্মসূচির মধ্যে ঢুকে নিজেদের পুনর্বাসনের পায়তারা করছে, পাশাপাশি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের এই বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে’। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘শহিদি লং মার্চ’ ও ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ প্রায় কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে জনমনে কিছু ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

সিলেটে ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ গাওয়ার অনুষ্ঠানের সূচি শুক্রবার। তবে এটা হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে নিরাপত্তা বিষয়ক আশ্বাস পাওয়া যায়নি। আয়োজকদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি, এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, খোদ বিভিন্ন সংস্থা আশঙ্কা করছে জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে আক্রমণ হতে পারে, এবং তারা এই আক্রমণ মোকাবেলা করতে পারবে না। জাতীয় সংগীত গাওয়ার এই অনুষ্ঠান শহিদ মিনারে হলেও হামলার আশঙ্কা আছে, তেমনি আশঙ্কা থাকবে অডিটোরিয়ামে করতে গেলেও। আয়োজকেরা জাতীয় সংগীত গাইতে বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের সহায়তা চাইলে তারা বিএনপি থেকে কোনধরনের আক্রমণ হবে না বলে আশ্বস্ত করলেও, অন্য কেউ আক্রমণ করলে সেটা তারা সামাল দিতে পারবেন না বলে নিজেদের অসহায়ত্বের প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন দেশে দেশেরই জাতীয় সংগীতই গাওয়া এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। প্রশাসন অনুমতি দিতে পারছে না হামলার আশঙ্কায়। অথচ এই হামলা থেকে রক্ষা তাদের দায়িত্বের অংশ ছিল।

‘ফ্যাসিজম হটিয়ে’ দেশে সংস্কার চলছে; ‘যাত্রী আসার আগেই কনভেয়ার বেল্টে পৌঁছে যাচ্ছে লাগেজ’; বাক স্বাধীনতা ফিরে এসেছে, ১৫ বছর কোথায় ছিলেন রব ওঠেছে; এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশে কেন তবে কেউ প্রকাশ্যে ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ গাইতে পারছে না? কেন নিরাপত্তা দিতে পারছে না প্রশাসন? আবার এও বলা যায়, জাতীয় সংগীত গাইতে নিরাপত্তার প্রশ্নই বা কেন ওঠবে?

‘আমার সোনার বাংলা...’ আমাদের জাতীয় সংগীত। এর পরিবর্তন হবে না, হতে পারে না। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর জাতীয় সংগীত নতুন ভাবে লেখার দাবিকে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী জে আই খান পান্না বলছেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’। ‘সে এই সাহস কোথা থেকে পায়’, প্রশ্ন রেখেছেন এই বর্ষীয়ান আইনজীবী। ছোট্ট অবস্থান থেকে আমরাও এই প্রশ্ন করতে চাই।