ফেনীতে নতুন আতঙ্ক ‘কাটুই পোকা’, নষ্ট করছে ফসল
ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষিখাত। ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বন্যা পরবর্তী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কৃষকদের নতুন আতঙ্কের নাম ‘কাটুই পোকা। যা ফল আর্মিওয়ার্ম নামে পরিচিত। এ পোকার মারাত্মক আক্রমণে নষ্ট হচ্ছে শীতকালীন নানা ফসল। পাশাপাশি ঘরবাড়িতেও কাটুই পোকার উপদ্রব বেড়েছে। পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বসবাসের জন্য যেতে বাধ্য হচ্ছেন বাসিন্দারা।
জানা গেছে, বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে জেলার সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ, নবাবপুর ও ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। নতুন করে জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার ও কয়েকটি জায়াগায় এ পোকার অবস্থান দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বন্যা পরবর্তীতে এ পোকার উপদ্রব বেড়েছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কালো রঙের অসংখ্য পোকা ফসলের মাঠে, রাস্তায়, বাড়িঘর ও আশপাশের বন-জঙ্গলে বিচরণ করছে। মানুষের বসতবাড়ির আঙিনাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রেও এ পোকার বিচরণ দেখা গেছে।
কৃষি কর্মকর্তারদের মতে, এ পোকা পানিতে থাকতে পারে না। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। সেখানে পুকুর, ডোবা-নালাসহ আমন ধানের মাঠে পানি থাকলেও পোকাগুলো পানির ওপর দিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছে। একস্থান হতে অন্যস্থানে চলাচল করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বন্যার পর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছেন তারা। এছাড়া বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম শীতকালীন সবজি লাউ, কুমড়া, করলা, ঝিঙে, পাট শাক আবাদ করেছেন, সপ্তাহখানেক পর সেগুলো বিক্রির উপযোগী হতো। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এ পোকার ব্যাপক আক্রমণ। পোকার আক্রমণ কমাতে জমিতে কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন তারা।
একই কথা বলছেন ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার কৃষকরাও। সেখানেও ফসলের মাঠে এ পোকার আক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ফুলগাজীর শ্রীপুরে এ আক্রমণ বেশি বলে জানান তারা।
ফুলগাজীর মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দঃশ্রীপুরের কৃষক ফজলু ভুঞা জানান, এ পোকার আক্রমণে ফসলের উৎপাদন বিনষ্ট হবে। এত পোকা আমার ৫৫ বছরের জীবনে কখনো দেখিনি। দেখতেও কেমন ভয় লাগে, কাছে গেলে শরীরে উঠে যায়। জমির পাশাপাশি এখন বাড়িঘরেও ঢুকে পড়েছে। এভাবে হলে মাঠের ফসল আর বাড়িতে তোলা সম্ভব না।
আমিরাবাদের আহম্মদপুর এলাকার কৃষক জামশেদ আলম বলেন, ১২ শতক জমিতে লাউ গাছের চারা রোপণ করেছিলাম। হঠাৎ এ পোকা এসে সবগুলো গাছের মূল কেটে দিয়েছে। এতে গাছগুলো শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি অফিসের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি। পোকাগুলোকে কীটনাশকের পানিতে রাখলেও মরে না।
কৃষক মোস্তফা বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটাতে ৬০ শতক জমিতে আগাম শাকসবজি আবাদ করেছিলাম। এখন সেগুলোও পোকায় নষ্ট করে ফেলছে। চেষ্টা করেও ফসল বাঁচাতে পারছি না।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন আহমেদ সোহাগ বলেন, এ পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পোকা দমনে ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের টিম কাজ করছে। কৃষি বিভাগ মাঠপর্যায়ে থেকে কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।
ফুলগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, ফুলগাজীর আমজাদহাট ইউনিয়নের মনিপুর ও মুন্সীরহাটের দক্ষিণ শ্রীপুর এলাকায় পোকার আক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা গেছে। পোকার উপদ্রব ঠেকাতে তিন ধরনের ওষুধ ছিটানো হয়েছে। কীটনাশক নাইট্রো ও কোরাজেন মিশ্রিত স্প্রে করে পোকা দমন করা হচ্ছে। বন্যার সময় কিছু কীটের লার্ভা ফসলের মাঠে আগাছার সঙ্গে মিশে থাকায় এ পোকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেবল ফসলের মাঠ নয়, ঘরবাড়িতেও ফল আর্মিওয়ার্ম বা কাটুই পোকার উপদ্রব বেড়েছে। সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের কৃষক ছুট্টো মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির রাস্তা, বসতঘর, টিউবওয়েল, শৌচাগার, বাড়ির আঙিনায় হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে।
কৃষক ছুট্টো মিয়া বলেন, এ ভয়ঙ্কর পোকা আগে কখনও দেখিনি। বাড়িতে এত পোকা ঢুকেছে যে আমরা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেও পারছি না। রাতে ঘুমালে পোকা গায়ে উঠে যায়। শৌচাগারে পানিও ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। বাড়ির চারদিকে কীটনাশক ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না, দিন দিন পোকা বাড়ছে। এ অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশা চালক বেলাল বলেন, পোকার উপদ্রবে বাড়িতে ঠিকভাবে হাঁটা-চলা করা যাচ্ছে না। কালো রঙের ৩-৪ ইঞ্চির এ পোকা দেখতেও ভয় লাগছে। ইতোমধ্যে ফসলের ক্ষেতে আক্রমণে সব শেষ হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন ছোট ছোট শিশু সন্তানদের নিয়ে বেশি বিপাকে রয়েছি।
পোকাটির বিষয়ে ফেনী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মোতাহার হোসাইন বলেন, সাম্প্রতিক বন্যা এ পোকার উপদ্রবের অন্যতম কারণ হতে পারে। পোকাটি সাধারণত মাঝারি ঠাণ্ডা ও গরমে বেশি বংশবিস্তার করে। বর্তমান সময়ের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি অনুকূলে রয়েছে। যা আমাদের জন্য বাড়তি শঙ্কার বিষয়।
মোতাহার হোসাইন বলেন, গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে ও শীতকালে ৭০-৮০ দিনের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী জাতের পোকা সাধারণত পাতার নিচের দিকে ১৫০০-২০০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীট বের হয়ে পাতা বা ফল খাওয়া শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ কীট মাটির ৮-১২ সেন্টিমিটার নিচে পুত্তুলিতে পরিণত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকাটি ৪-৫টি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে।
এ পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাজারে রিপকর্ড নামে কার্যকরী একটি স্প্রে জাতীয় ওষুধ রয়েছে। কৃষকরা যদি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেন তাহলে শীতকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। কারন এ পোকা ধান গাছ থেকেও শীতকালীন সবজিগুলোর পাতায় বেশি দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ও আমিরাবাদ এবং ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর এলাকায় এ পোকার দেখা মিলেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন বালাইনাশক স্কোয়াড গঠন করা হয়েছে। নাইট্রো ও কোরাজেন মিশ্রিত করে প্রয়োগ করলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। সেভাবেই কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে জমিতে আলোর ফাঁদ ও পাখি বসার মত কিছু বসাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকে বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োগের বিষয়েও কৃষকদের বলা হচ্ছে। ফসল অনুযায়ী জমিতে সম্ভব হলে পানি রাখতেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রথমদিকে সমস্যা বেশি থাকলেও এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।