লোকসানের বৃত্তে পাটের সুদিন ফিরে আসার স্বপ্ন অধরা!
পণ্যের মোড়কে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন আছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োগ নেই বললেই চলে। দেশে পাট পণ্য উৎপাদনে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প আছে কিন্তু বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেই। এতে পাট ও পাটজাত পণ্যের সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে বহুকাল ধরে। লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছেন না কৃষক, পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও রফতানিকারকেরা।
খুলনা বিভাগীয় পাট অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পাট ও পাটজাত পণ্যের সুদিন ফিরিয়ে আনতে ২০১০ সালে মোড়কে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন করে সরকার। এর ফলে দেশে প্রতিবছর ১’শ কোটি পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়। ধাপে ধাপে প্রথমে ৬টি এরপর মোট ১৯টি পণ্যের সংরক্ষণ ও বিপণনে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। শুরুতে আইন প্রয়োগে পাট মন্ত্রণালয় সচেষ্ট থাকলে সময়ের আবর্তে দীর্ঘ ৯ বছরে ঝিমিয়ে পড়েছে সে উদ্যোগ।
আরো জানা যায়, ২০১৫ সালে ১৯টি পণ্যে পাটের বস্তার ব্যবহারে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করলে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলি লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়া আসার স্বপ্ন বুনতে থাকে। ২০১৬ সালের প্রথম দুই মাসে খুলনা যশোর অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল উৎপাদন করে প্রায় ৮০ লাখ বস্তা। কিন্তু বিক্রি হয় মাত্র ১০ লাখ বস্তা। কারখানাগুলোতে বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও বিজেএমসির ত্রুটিপূর্ণ বিপণন ব্যবস্থার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন।
এছাড়া উচ্চ আদালতের নিদের্শে ৭টি পণ্যে (চিনি, ডাল, আটা, ধান, গম, ভুট্টা, চাল) পাটের বস্তা ব্যবহারে স্থগিতাদেশের পর বন্ধ হয়ে যায় চটের বস্তার ব্যবহার। একইসঙ্গে আমদানি পণ্যেও মানা হচ্ছেনা পণ্যের মোড়কীকরণ আইন।
পাট অধিদফতরের মুখ্য পাট পরিদর্শক রাধে শ্যাম নাথ বলেন, মোট ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের রিটের প্রেক্ষিতে ৭টি পণ্যের মোড়কে ব্যবহারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরে চালের ওপর থেকে তা প্রত্যাহার করে। ফলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চিনি, ডাল, আটা, ধান, গম ও ভুট্টার সংরক্ষণ-বিপণনে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে বিদেশ থেকে আসা পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ১২টি পণ্যেও ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পাটের বস্তা ব্যবহার করছে না। বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের সংকট রোধে এর বিরুদ্ধেও কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মোড়কে পাট পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ব্যহত হচ্ছে।
পাট অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬০৮ ভ্রাম্যমাণ আদালত ১.৫১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড ও দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪৭৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ১.১১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৪৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ৬৩.৩১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৯৭টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ৬৫.৩১ লাখ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে।
বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা বণিজ উদ্দিন মিঞা বলেন, বিপণন ব্যবস্থা ভালো করতে ও পাটখাত স্বনির্ভর হবার জন্য আমার প্রযুক্তি পাল্টাতে হবে। একইসঙ্গে লোকবল বাড়াতে হবে এ খাতে। পণ্যে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়নের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার স্বপ্ন দেখেতে থাকে। কিন্তু বহুমুখী পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু না হওয়া ও বিজেএমসির বিপণন ব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকায় মিলগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে থেকে যেখানে মিলগুলোর লাভে যাওয়ার কথা, সেখানে গত পাঁচ বছরে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯ জুট মিলে লোকসান ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা।
কাঁচাপাট রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশে জুট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, বিগত ৫ বছরে পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে কাঁচাপাট রফতানি বেড়েছে। গতবছর সরকার কাঁচাপাট রফতানি বন্ধ ঘোষণা করায় অধিকাংশ বিদেশি ক্রেতাই এখন আর বাংলাদেশ থেকে পাট কিনতে চান না। ফলে কাঁচাপাটের বাজার এখন ভারত নির্ভর যার সুবিধা নিচ্ছে ভারতীয় ক্রেতারা, লোকসান গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের।
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ শহিদুল ইসলাম জানান, বিগত বছরে খুলনা অঞ্চলের ১৪০ জনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ২’শতাধিক ব্যবসায়ী কাঁচাপাট রফতানি করতো। কিন্তু ২০১৯ সালে কাঁচাপাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে অধিকাংশ রফতানিকারক লোকসানে পড়ে এবং ব্যাংকে খেলাপি হয়ে পড়ে। ব্যববসায়ীদের প্রণোদনা দিতে প্রধানমন্ত্রী ও পাটমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোকে কাঁচাপাট রফতানিকারকদের ব্লকঋণ সুবিধা দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক তা বাস্তবায়ন না করায় পুঁজি সংকটে বর্তমানে দেশে মাত্র ২০ জন রফতানিকারক কাঁচাপাট রফতানি করছে।
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পিয়াস জানান, অর্থ সংকটে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ফড়িয়াদের টাকা দিতে পারছে না। ফলে ফড়িয়ারা কৃষকদের কাছ থেকে কেনা পাটের দামও পরিশোধ করছে না। পাট ও পাটজাত পণ্যের সুদিন ফিরেয়ে আনতে যে আইন আছে তার সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকায় ব্যবসায়ী থেকে কৃষক সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে যা কাম্য নয়।