হাইব্রিড-বিতর্কিতে ভরা খসড়া কমিটি, বাদ পড়ছেন ত্যাগীরা

  • হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ

সম্মেলনের মাধ্যমে আংশিক কমিটি ঘোষণার তিন মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেতে যাচ্ছে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটির খসড়া তালিকা জমা দিয়েছেন আংশিক কমিটির নেতারা। খসড়া কমিটি নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। অনুমোদনের আগেই তা ছড়িয়ে পড়েছে নেতাকর্মীদের হাতে হাতে। খসড়া কমিটির একটি কপি এসেছে বার্তা২৪.কম-এর প্রতিবেদকের হাতেও।

কমিটি ঘেঁটে দেখা যায়- ৭৫ সদস্যের কমিটি করার থাকলেও সেখানে দেয়া হয়েছে ৭৪ জনের নাম। বাদ পড়েছেন আগের কমিটির অন্তত ৪০ জন সিনিয়র নেতা। তাদের জায়গায় ঢুকে পড়েছেন হাইব্রিডরা। যার মধ্যে রয়েছে বিএনপি থেকে আসা নেতারাও।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া রয়েছে হত্যা মামলার আসামি, সরকারি চাকরিজীবী, সাংগঠনিক কাজে নিষ্ক্রিয় ও শীর্ষ দুই নেতার আত্মীয়দের নামও। ফলে কমিটি অনুমোদনের আগেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন আংশিক কমিটির নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক এমপি মেরাজ উদ্দিন মোল্লাকে সভাপতি ও রাজশাহী-৫ আসনের সাবেক এমপি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে সাধারণ সম্পাদক করে চার সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে যুগ্ম-সম্পাদক বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু ও রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিনকে রাখা হয়।

বিজ্ঞাপন
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের খসড়া কমিটি

কেন্দ্রীয় নেতারা কমিটি ঘোষণার সময় আংশিক কমিটির নেতাদের ১ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। তবে প্রায় তিন মাসেও তা পূর্ণাঙ্গ করতে না পারায় গত ১ মার্চ রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এসে ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে যায়। তবে বেঁধে দেয়া সময়ের তিন দিন আগেই খসড়া তালিকা কেন্দ্রে জমা দেয় তারা।

খসড়া কমিটি অনুযায়ী- সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। সহ-সভাপতিরা হলেন- অনিল কুমার সরকার, আমানুল আহসান দুদু, অধ্যক্ষ আ.ন.ম মনিরুল ইসলাম তাজুল, অধ্যক্ষ এসএম একরামুল হক, রিয়াজ উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম দুলাল, শরীফুল ইসলাম শরীফ, সাবিয়ার রহমান মাস্টার, শরীফ খান, সোহরাব হোসেন ও জাকিরুল ইসলাম সান্টু।

সাধারণ সম্পাদক কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু, আয়েন উদ্দিন ও মোস্তাফিজুর রহমান মানজাল। সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম আসাদুজ্জামান আসাদ, অ্যাডভোকেট আবদুস সামাদ, আবুল কালাম আজাদ।

আইন বিষয়ক সম্পাদক এজাজুল হক মানু, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক প্রতীক দাস রানা, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মেহবুব হাসান রাসেল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক রেজাওয়ানুল হক পিনু মোল্লা, দপ্তর সম্পাদক প্রদ্দ্যেত কুমার সরকার, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এন্তাজ আলী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমজাদ হোসেন নবাব।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের খসড়া কমিটি

বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কামরুল ইসলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জিএম হিরা বাচ্চু, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক পূর্ণিমা ভট্টাচার্য, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আলী খাজা, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ, শিক্ষা ও মানব বিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হক, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক জিয়াউদ্দিন টিপু।

শ্রম সম্পাদক আসলাম আলী, সাংষ্কৃতিক সম্পাদক মামুনুর রশঈদ সরকার মাসুদ, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. চিন্ময় দাস। উপ-দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. বাক্কার ও কোষাধ্যক্ষ আজিজুল আলম।

সদস্যরা হলেন- বেগম আখতার জাহান, ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি, আসাদুজ্জামান আসাদ, শাহরিয়ার আলম এমপি, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক এমপি, ডা. মুনসুর রহমান এমপি, আদিবা আনজুম মিতা এমপি, অ্যাড. ইব্রাহিম হোসেন, আবদুস সালাম, নজরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, ইয়াসিন আলী, সাইফুল ইসলাম বাদশা, আক্কাছ আলী, ফকরুল ইসলাম, গোলাম রাব্বানী, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আবদুল মালেক, আশরাফুল ইসলাম বাবুল, অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, অধ্যক্ষ গোলাম সারওয়ার আবুল, শহিদুজ্জামান শহিদ, রবিউল ইসলাম রবি, আবদুর রাজ্জাক, সরদার জান মোহাম্মদ, খাদেমুন নবী চৌধুরী, সামশুল ইসলাম, শিউলী রানী সাহা, মাহবুবুল আলম মুক্তি, মরজিনা বেগম, সুরঞ্জিত কুমার সরকার, আবদুল মান্নান, নীলিমা বেগম এবং বদরুল ইসলাম তাপস।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের খসড়া কমিটি

খসড়ায় হাইব্রিড ও বিতর্কিত যারা

সরকারি চাকরিজীবী হয়েও কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন মোজাম্মেল হক ও একরামুল হক। অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক দুর্গাপুর উপজেলার দাওকান্দি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ। আর একরামুল হক পুঠিয়ার বানেশ্বর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ পেতে যাওয়া গোদাগাড়ীর সাবিয়ার রহমান মাস্টার কোনোদিন দলই করেননি। দলে তার কোনো পদও ছিলো না। তবে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নৌকা প্রতীক পেয়েও বড় ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি।

দলীয় নেতাদের অভিযোগ- মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেতে যাওয়া আলী খাজাও কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি। নগরীর ঘোষপাড়া এলাকার মরু হামিদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি তিনি। রায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। দপ্তর সম্পাদকের পদ পেতে যাওয়া প্রদ্দ্যুত কুমার সরকারও কখনো দলের ইউনিয়ন, উপজেলা কিংবা পৌর কমিটির পদ-পদবিতে ছিলেন না। কমিটির সাধারণ সম্পাদকের এলাকা দুর্গাপুরের নওপাড়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক প্রদ্দ্যুত দলে হাইব্রিড।

সদস্য হিসেবে পদ পেতে যাওয়া নীলিমা বেগমের রাজনৈতিক পরিচিতি হিসেবে লেখা হয়েছে তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। অথচ দলীয় নেতারা নিশ্চিত করেছেন- নীলিমা কখনই মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন না। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে যাওয়া খাদেমুন নবী চৌধুরী আগে বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগে তিনি হাইব্রিড। অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম দলীয় কার্যক্রমে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়।

শ্রম সম্পাদক হতে যাওয়া আসলাম আলীর নামের পাশে রাজনৈতিক পরিচিত হিসেবে লেখা হয়েছে পুঠিয়া উপজেলা শ্রমিক লীগের নেতা। অথচ এই নামে শ্রমিক লীগের কোনো নেতাকে চিনতেই পারছেন না দলীয় নেতারা। ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হতে যাওয়া রেজওয়ানুল হক পিনু সভাপতি মেরাজ মোল্লার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পেতে যাওয়া মো. বাক্কারের রাজনৈতিক পরিচিত হিসেবে লেখা হয়েছে পবা থানা আওয়ামী লীগের নেতা। অথচ তিনিও কোনো পদ-পদবীতে ছিলেন না।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের খসড়া কমিটি

বাদ পড়ছেন যারা:

আগের কমিটি থেকে বাদ পড়া ৪০ নেতার মধ্যে অন্যতম সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেসা তালুকদার, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য একেএম আতাউর রহমান খান, গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদরুজ্জামান রবু মিয়া, বদিউজ্জামান বদি।

সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান, জেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল মজিদ সরদার, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু, পবা উপজেলা চেয়ারম্যান মুনসুর রহমান, আগের কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আখতারুজ্জামান আক্তার, প্রবীণ নেতা আবদুল বারীর মতো ত্যাগী নেতারা।

তবে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটি অনুমোদন হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের আগে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবো না।’

আর গঠনতন্ত্রে ৭৫ সদস্য থাকলেও ৭৪ সদস্যের কমিটি জমা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাই, এটা হয়েছে নাকি! জানি না তো! একজনের নাম কম থাকলে কেন্দ্র থেকে আরেকজনের নাম ঢুকিয়ে দেবে।’

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা এসএম কামাল হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘খসড়া কমিটি জমা হয়েছে শুনেছি। তবে এখনও খসড়া কমিটি নিয়ে আমরা বসতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে এখন মন্তব্য করা উচিতই হবে না। পর্যালোচনা করে দেখি, যদি বিতর্কিত এবং হাইব্রিড সত্যিই থেকে থাকে তবে তারা বাদ পড়বে।’