নির্বাচনী রাজনীতি, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নির্বাচনী রাজনীতি, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ

নির্বাচনী রাজনীতি, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ

বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে যে চাপা-উত্তেজনা ও সংঘাত-বান্ধব পরিস্থিতি চলছে, তার একটি অত্যন্ত হতাশাজনক বৈশিষ্ট্য হলো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক অনুমোদন বা দলীয় পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে শান্তি ও সমঝোতার জন্য কাজ করতে পারছেন না। তাত্ত্বিকভাবে যতই বলা হোক, শান্তিপূর্ণ সমাধানে নাগরিক সমাজকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, বাস্তবে তা অধরা। প্রায়-সবাই কথা বলছেন বিশেষ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে। এতে দলীয় রাজনীতি প্রাধান্য পেলেও 'সামগ্রিক জনস্বার্থ' উপযুক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে সংঘাতের আশঙ্কার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নাগরিক সমাজ, সিভিল সোসাইটি, এলিট ও বুদ্ধিজীবীদের মেরুকরণ, যা প্রকারান্তরে জনগণের মধ্যে বিভেদ, দূরত্ব ও উত্তেজনা বৃদ্ধিতে অনুঘটকের কাজ করছে।

বিদ্যমান এহেন পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে 'বাফার জোন' বা 'নিরপেক্ষ পরিসর' বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। ব্যক্তি, বক্তা, গোষ্ঠী ও পত্রিকার নাম শুনলেই আমজনতা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন 'তারা কোন পক্ষের'। পক্ষপাতে আকীর্ণ পক্ষগুলোর কাছ থেকে নিরপেক্ষ বক্তব্য, সামগ্রিক বিবেচনা, প্রকৃত জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আচরণ প্রত্যাশা করা যায় না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আশার আলো দেখাতে কেউই পারছেন না, এটাই রূঢ় বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যেমন তাদের পক্ষে নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের একত্রিত করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও উন্নয়ন সহযোগীগণও একই কাজ করছে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো তাদের সংকীর্ণ দলীয় পরিচয়ের ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সংঘাতের আশঙ্কায় সমস্যায় পড়া জনগণকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারছে না। এমন ব্যক্তিও অনুপস্থিত, যিনি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রদানের জন্য সক্রিয় হতে পারেন, সকলের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়াতে পারেন এবং শান্তি ও স্থিতি বেগবান করতে সাহায্য করতে পারবেন।

এটাই সবিশেষ দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বাস্তবে এমন গ্রহণযোগ্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বরং এই নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোই রাজনৈতিক হিংসা ছড়াতে, বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে সাহায্য করছে। এর সাথে রয়েছে রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও নির্লজ্জ দালালি। তাই সামনে মুক্তির কোনো রাস্তা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। ফলে সুপ্ত সংঘাতের শেষ কোথায়, কেউ জানে না।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র নিরপেক্ষ নেতৃত্ব এবং নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা থেকেই সম্পর্কের শীতল বরফ গলে জল হতে পারে। তবে বর্তমানে যা বাস্তব পরিস্থিতি, তাতে নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বস্ততার লেশমাত্র নেই। এজন্যই একটি বিকল্পের প্রয়োজন আছে। নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ হতে পারতো যথার্থ বিকল্প। তাদের উদ্যোগে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব ছিল। শান্তি ও সমঝোতার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই আশাও ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে।

এদিকে, আসছে নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল আর জানুয়ারিতে ভোট, এমন জানা যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে। একই সাথে বিরাজমান রয়েছে নির্বাচন ঘিরে অচলায়তন। দলগুলোর মধ্যে যেমন সমঝোতা ও ঐকমত্য নেই, তেমনি নাগরিক পরিসর তথা সুশীল সমাজের কণ্ঠও উচ্চকিত নয়। বিভাজিত নাগরিক সমাজ জনগণকে সংগঠিত করে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথকে কণ্টকমুক্ত করতেও পারছে না।

বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র যদি না থাকে, সংসদ যদি বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল না হয়– তাহলে জনস্বার্থ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। এজন্যই সকল বিরোধের মীমাংসা করে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকতে হবে। জনগণকে পছন্দ করতে দিতে হবে তাদের নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার। শুধু সংবিধান নয়, জাতির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় না। ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক বিভেদের পঙ্কে সমগ্র দেশ ও জাতিকে নিমজ্জিত করাও যায় না।

গণতান্ত্রিক ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজের জনবান্ধব-অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য নেতৃত্বে যারা আছেন বা আসতে চান, তাদের সবার আগে দেশের স্বার্থ দেখতে হবে এবং জনগণের কথা শুনতে হবে। একই সাথে গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা তথা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার না থাকার বিপদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের পথকেও মসৃণ রাখতে হবে।

এসব কাজে গাফিলতি হলে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও ঘণীভূত হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়নে ব্যত্যয় ঘটবে, দারিদ্র বৃদ্ধি পাবে, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন আরও ভঙ্গুর দশায় নিপতিত হবে। হত-দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দেওয়াও তখন অসম্ভব হবে। বাড়বে ঋণের বোঝা, যা থেকে নতুন নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটও তৈরি হবে। বলা বাহুল্য, নির্বাচনের অনেক আগেই বাজার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সমাজ ও বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি বেড়েছে। এসবই অশনিসংকেত বিশেষ।

অতএব, সামাজিক স্থিতি ও সুষম উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের ধারাবাহিক উত্তরণ দরকার। আর সেটা সম্ভব হবে নির্বাচন ব্যবস্থায় সমঝোতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। দেশের বিবদমান নির্বাচনী রাজনীতিকে তাই শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে সমঝোতায় আসতে হবে। এবং রাজনৈতিক দ্বৈরথ থামিয়ে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের অনুকূল পরিস্থিতি সৃজনে নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজকে শির উঁচিয়ে দাঁড়াতেই হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।