কান্নায় শেষ কিংবদন্তির বিশ্বকাপ
‘মরুর বুকে বিশ্ব কাঁপে’খেলোয়াড়ি জীবনে ব্যক্তিগত ও দলগত অনেক অর্জন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। ব্যালন ডি'অর, প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লিগ শিরোপা, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, উয়েফা নেশনস লিগ শিরোপা; কী নেই রোনালদোর ঝুলিতে? তবে একটাই বাকি—বিশ্বকাপ শিরোপা; সেটা জেতা হয়নি রোনালদোর।
পর্তুগাল কখনও বিশ্বকাপ জেতেনি। ফুটবল কিংবদন্তি ইউসেবিও-লুইস ফিগোদের পর্তুগাল কখনও ইউরো জিততে পারেননি। তবে পর্তুগালের সোনালী প্রজন্মের প্রতিনিধি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর হাত ধরে এসেছে ইউরোর শিরোপা।
রোনালদো পাঁচ বিশ্বকাপ খেলেছেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একাধিকবার প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে নিয়ে গেছেন দেশকে। এবারও একইভাবে দলকে নিয়ে গেছেন বিশ্বকাপে। এবার পর্তুগালের বিশ্বকাপ সম্ভাবনা প্লে-অফে ঝুলছিল যখন তখন বলেছিলেন, যেকোনো মূল্যে বিশ্বকাপে নিয়ে যাবেন দেশকে। রোনালদোরা কথা রেখেছিলেন। ইচ্ছা ছিল বিশ্বকাপে দেশকে অর্জন দিয়ে রাঙাতে, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি।
রোনালদো বিশ্বকাপ জেতেননি। বর্তমানে যে ফর্ম এবং বয়স তাতে আর বিশ্বকাপ খেলা হবে না তার—এটা নিশ্চিতই। এই অপ্রাপ্তি নিয়ে চোখ মুছতে-মুছতে মাঠ ছেড়েছেন তিনি। জানেন ভালো করেই ফুটবলের এই মহামঞ্চে ফুটবলার হিসেবে আর নামা হবে না তার, কারণ একটাই বয়সের বাধা; আগামী ফেব্রুয়ারিতে আটত্রিশ হবে তার।
কিংবদন্তি ফুটবলার হয়েও কেবল কি তিনিই একাই বিশ্বকাপ জয়ী হতে পারেননি? না, ফুটবলের আরও অনেক মহাতারকা বিশ্বকাপ না জিতেও খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি টেনেছেন। তবে ফুটবল তাদের ঠিকই মনে রেখেছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও বুঝি বিশ্বকাপ না জেতা সেই সব মহাতারকাদের তালিকায় নিজের নাম লিখালেন!
সংক্ষিপ্ত করে তালিকা করলে দেখা যায় ওখানে আছেন— লেভ ইয়াসিন, পাওলো মালদিনি, জর্জ বেস্ট, মিশেল প্লাতিনি, জিকো, সক্রেটিস, ইউসেবিও, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, ইয়োহান ক্রুইফ, অলিভার কান, ডেভিড বেকহাম, লুইস ফিগো; ফুটবল সম্পর্কে জানাশোনা থাকলে এই নামগুলো মনে পড়ার কথা। কিংবদন্তি এই ফুটবলাররা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক কিছু জিতলেও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। এই মহাতারকাদের মতো আরও অনেকেই বিশ্বফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের শিরোপা জিততে পারেনি, কেউ খেলতেও পারেননি বিশ্বকাপ। তবে ফুটবল মনে রেখেছে তাদের, মনে রাখবে নিশ্চিত।
কাতারে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো খেলে ফেলেছেন তার শেষ বিশ্বকাপ। ধারণা করা যায়, পঁয়ত্রিশের লিওনেল মেসি খেলছেন তারও শেষ বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে পৌঁছার সুবাদে আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসির এখনও সুযোগ বিশ্বকাপ জয়ের। তবে মরক্কোর কাছে হেরে বিশ্বকাপ জয়ের আরাধ্য স্বপ্নে ছেদ পড়েছে পর্তুগিজ মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর।
শনিবার (১০ ডিসেম্বর) দোহার আল থুমামা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আফ্রিকার দেশ মরক্কোর কাছে ১-০ গোলে হেরে গেছে রোনালদোর পর্তুগাল। আর এতেই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন-পথ থেমে গেল রোনালদোর। আগের ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও পর্তুগিজ কোচ ফার্নান্দো সান্তোস শুরুর একাদশে রাখেননি রোনালদোকে। ম্যাচের ৫১তম মিনিটে রুবেন নেভেসের জায়গায় বদলি হয়ে নামা রোনালদো যখন মাঠে নামার অপেক্ষায় ছিলেন তখন সতীর্থ পেপে এগিয়ে এসে পরিয়ে দেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড; পর্তুগালের অধিনায়ক ও মূল নেতা যে রোনালদোই।
মাঠে নামার পর পরই বলের জন্যে মরিয়া ছিলেন রোনালদো। মরক্কোর জমাট রক্ষণ ভেদ করার অভিপ্রায়ে বলের সন্ধান করতে হয়েছে তাকে। বারবার সতীর্থদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বুভুক্ষু হয়ে। কয়েকবার বলের জন্যে তাকে নেমে যেতেও হয়েছে অনেক নিচে। ম্যাচে সংক্ষিপ্ত সময়ে কয়েকবার দেখানোর চেষ্টা করেছেন ঝলক। দুর্দান্ত কিছু পাসও বাড়িয়েছেন। এক গোলে পিছিয়ে পড়া দলকে উদ্ধার করতে ম্যাচের ৯০তম মিনিটে বাঁ-দিক থেকে একটা শটও নিয়েছিলেন তিনি, শটটি রুখে দিয়েছেন গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো।
রোনালদোর দল ম্যাচ হারে ১-০ গোলে, বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের সেই মুহূর্তে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সিআরসেভেন। অপ্রাপ্তির বেদনায় বেদনার্ত হৃদয়ে মাঠ ছাড়েন পর্তুগালকে স্বপ্ন দেখানো এই মহাতারকা। টানেলে হেঁটে যাওয়ার সময় টেলিভিশনে ধরা পড়ে চোখ মোছার বিষয়টিও।
এবারের বিশ্বকাপ দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডের মালিক এই ফুটবলার। প্রথম ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে প্রথম গোলটি আসে তার পা থেকেই। এই গোল করে তিনি বিশ্বকাপে গড়েন এমন এক কীর্তি যা আগে দেখেনি বিশ্বকাপ। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা পাঁচ আসরে গোল করার অনন্য কীর্তি গড়েন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। এর পরেই কোনো ম্যাচে আর গোল পাননি রোনালদো। প্রথম বিশ্বকাপের মতো তার শেষ বিশ্বকাপও শেষ হয় মাত্র এক গোল করেই।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডের মালিক রোনালদো কান্নায় বিদায় নেওয়ার দিনে স্পর্শ করেছেন আরেক রেকর্ড। এবারের রেকর্ড আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার, যে রেকর্ডটি এতদিন ছিল কুয়েতের ফরোয়ার্ড বাদের আল-মুতাওয়ার। দুজনই খেলেছেন ১৯৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
বিশ্বকাপে ২২ ম্যাচ খেলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো একটি হ্যাটট্রিকসহ করেছেন ৮ গোল। বিশ্বকাপে পর্তুগালের পক্ষ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। ৯ গোল করে শীর্ষে আছেন আরেক কিংবদন্তি ইউসেবিও। পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে ১৯৬ ম্যাচ খেলে রেকর্ড ১১৮টি গোল করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
বিশ্বকাপ জিতেছেন অনেকেই, বিশ্বকাপ না জেতা ফুটবলার তারচেয়েও বেশি। কিন্তু ক'জন মনে রাখে কার কথা! কিন্তু রোনালদোকে মনে রাখতে বিশ্বকাপে সাফল্য-ব্যর্থতা দরকার পড়বে না। ফুটবলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো একটা ব্র্যান্ডই! তিনি কেবলই ফুটবল খেলেননি, তিনি ইতিহাসকেও ফুটবল খেলিয়েছেন। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন অধরা যদিও, তবে ফুটবল দিয়েছে তাকে অমরত্বের নিশ্চয়তা!