'এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো না', গানে কয়েক প্রজন্মকে রোমান্টিক আবহে শিহরণ জাগানো শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (৪ অক্টোবর ১৯৩১-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২) জীবনের পথ শেষ হলো। সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকারের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই পরলোকে যাত্রা করেছেন বাংলার গীতশ্রী।
সন্ধ্যার গান ছিল আধুনিক বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের মাইলস্টোন। 'সপ্তপদী' সিনেমার গীত এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো না', গান যেন বাংলা প্রেমের সিনেমার আইকন। গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানটির কথা লেখেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
আরও পড়ুন: আমি বাংলায় গান গাই...
সন্ধ্যার 'তুমি না হয় রহিতে কাছে' গানটি বিখ্যাত 'পথে হল দেরী' সিনেমায় সুচিত্রা সেনের লিপে আজও বাঙালির মনের খুব কাছে সংরক্ষিত। তার 'মধুমালতী ডাকে আয়' গানটি 'চয়নিকা' নামের একক অ্যালবামের ব্যাপকহারে জনপ্রিয়তা পায়, যা এতোদিন পরেও ভাটা পড়েনি। 'কি মিষ্টি দেখ মিষ্টি' গানটি 'নায়িকা সংবাদ' সিনেমার জন্যে গাওয়া সন্ধ্যার আরেক নন্দিত গান।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়াতে ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন। তার পিতামহ একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং পরিবারটি ১৯১১ সাল থেকে ঢাকুরিয়াতে বসবাস করতেন।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন। তবে তার প্রধান গুরু ছিলেন প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান এবং তার পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান। যাদের অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন। এজন্যই সিনেমায় নেপথ্য গানের উজ্জ্বল গৌরব অর্জনের পরেও একজন শাস্ত্রীয় গায়ক হিসাবে তিনি জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হন।
গানের জগতে সন্ধ্যার আবির্ভাব নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সের কিশোরী রূপে তিনি প্রথম রেকর্ড করেন সুখ্যাত 'কলম্বিয়া কোম্পানি' থেকে। রেকর্ডে তার দুটি আধুনিক গান ছিল: গিরীন চক্রবর্তীর কথায় ও সুরে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ ও ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে’। এর বছর দু’য়েকের মধ্যেই দু’টি বাংলা ছবিতেও নেপথ্যে গাইবার সুযোগ হয়ে গেল তার। রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘অঞ্জনগড়’ এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘সমাপিকা’ ছবিতে।
শুধু তাই নয়, একই বছরে অর্থাৎ ১৯৪৮-এ তিনটি আধুনিক গানের রেকর্ড বের হয় তার। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮, এই তিন বছরের উজ্জ্বল সঙ্গীতযাত্রাই বলে দিয়েছিল যে, এই কিশোরী বাংলা গানের জগতে স্থায়ীভাবে থাকতেই এসেছেন। সঙ্গীত জীবনের সুদীর্ঘ যাত্রা শেষে ৯০ বছর বয়সে পরলোকগমনের সনয় তিনি পরিণত হয়েছিলেন— জীবন্ত কিংবদন্তি।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সঙ্গীতস্রষ্টা শচীনদেব বর্মনের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে। প্রথম বাংলা ছেড়ে যাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন তিনি। অনেক অনুরোধ-উপরোধে তিনি মুম্বইয়ে যান স্বয়ং শচীন কর্তা ডাক অমান্য করতে পারেননি বলে। বাংলা আধুনিক গানের পাশাপাশি ১৯৫০ সালে 'তারানা' চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে তিনি মুম্বাইতে হিন্দি গান গাওয়া শুরু করেন। তিনি ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান গেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি আবার তার কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালী কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। শ্যামল তার অনেক গানের জন্য কথা লিখে দিয়েছিলেন।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের জুটি ছিল হেমন্ত মুখার্জীর সাথে, যার সাথে প্রাথমিকভাবে বাঙালি চলচ্চিত্রগুলোর জন্য নেপথ্য গায়িকা হিসাবে তিনি বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। হেমন্ত ও সন্ধ্যা বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার এবং তার অসংখ্য নায়িকা জোড়াগুলোর নেপথ্য কণ্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে। হেমন্ত মুখার্জির রচনা ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তিনি অনেক কাজ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন তিনি। তিনি বাংলাদেশী সংগীতশিল্পী সমর দাস, যিনি বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, তার সাহায্যার্থে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেন। কারাগারে বন্দী নতুন বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে তার গাওয়া 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে' গানটি মুক্তি পায় তার কণ্ঠে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে অনুষ্ঠান করা তিনি অন্যতম প্রথম বিদেশি শিল্পী।
বাংলা গানে স্বর্ণযুগের রোমান্টিক শিল্পীদের শেষ তারকা সন্ধ্যা নিভে গেলেন করোনাকালের এক বসন্তের শুরুতে। আধুনিক বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা একে একে চলে গিয়েছেন আগেই। এ বার নিভল সন্ধ্যা-প্রদীপও। মাত্র কিছুদিন আগেই চলে গেলেন লতা। দুই সঙ্গীত শিল্পীই প্রায়-সমবয়ষ্ক। দুজনেরই বয়স ৯০-এর উপরে। লতার ৯২, আর সন্ধ্যার ৯০। উভয়েই দুই ভিন্ন জগতে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। আবার অসুস্থও হন উভয়ে একইসঙ্গে। লতা মঙ্গেশকর মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্ধ্যা মুখ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন কলকাতার এক হাসপাতালে।
কিন্তু উভয়ের মধ্যে মিলের মতোই অনেকাংশে অমিলও ছিল। লতা মঙ্গেশকর ভারতরত্ন-সহ ভারত সরকারের সমস্ত পুরষ্কার পেলেও সন্ধ্যা মুখ্যোপাধ্যায়কে ৯০-এর কোটায় এসে পদ্মশ্রী দেওয়ার সুপারিশ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। অপমানে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন গীতশ্রী। তারপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অবশেষে চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে।
চিরবিদায়েও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অম্লান হয়ে আছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আলমগীর কবিরের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র 'ধীরে বহে মেঘনা'য় 'কতো যে ধীরে বহে মেঘনা' গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অপূর্ব কণ্ঠ দিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৫ সালে নির্মিত আলমগীর কবিরের আরেক ছবি 'সূর্য কন্যা'য় সন্ধা মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্রের গানগুলো আজও দোলা দেয়। জীবনের পথ শেষ করে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেও তিনি থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, তার গানের কথা ও সুরের মোহনীয় আবেশে।
আরও পড়ুন: চিরঘুমের দেশে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়