নারীরা চার দেয়ালের ঘেরাটোপ ভেঙে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অফিস-আদালতে কাজ করছেন। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানান আয়বর্ধক কাজে অদম্য উৎসাহে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। নারীরা এখন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রর গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মনিয়োজিত। তথাপি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো বদলায়নি নারীদের প্রতি পুরুষের মানসিকতা। এ কারণেই কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো নিপীড়নের শিকার হন, মুখোমুখি হন ব্যক্তিগত নানা বিড়ম্বনার। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দীর্ঘ এই সময়েও সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা-বিড়ম্বনা কর্মজীবী নারীদের পিছু ছাড়ছে না।
নারীরা প্রতিবন্ধকতা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার এই চিত্র প্রায় সর্বক্ষেত্রে। মফস্বল এলাকায় এই চিত্র যেন আরও বেশি। কয়েকজন কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা বলে উঠে আসে এমন না জানা অনেক তথ্য।
বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি জান্নাতুল ফেরদৌস নয়ন বলেন, বিদ্যমান সামাজিক কুসংস্কার-অপসংস্কৃতি দূর করার আন্দোলনে অংশীদার হতে কলম যোদ্ধা হিসেবে পথচলা শুরু করি। ইতিমধ্যে এ পথচলার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেছি। অথচ সামাজিক বিড়ম্বনা থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি। এই পথচলায় ব্যক্তিগত জীবনে আমার অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। পেশাগত জীবনের পথচলার শুরু থেকে আজকের জায়গায় আসতে অনেক কষ্ট, নিভৃত কান্নার নোনা জল রয়েছে। বৈরিতার সাথে লড়তে লড়তে আজকের এই পর্যায়ে এসেছি। তবে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতাও পেয়েছি। যা কোনদিনই অস্বীকার করার নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী জানান, কুদৃষ্টি, গায়ে ধাক্কা, অশ্লীল ইশারা, কুপ্রস্তাব, অশ্লীল কথাবার্তা—এ ধরনের অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় নারীকে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অফিসের বড় কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে তাদের কক্ষে ডেকে পাঠান। আকার-ইঙ্গিতে নানা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন। বুঝলে বিপদ, না বুঝলেও বিপদ।
পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা নানা ধরনের গসিপ, কানাকানি, কথা লাগানো তো নিত্য ঘটনা। বস ও সহকর্মী দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক কর্মজীবী নারীকে। ঘটে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা।
এ বিষয়ে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী পারভিন হালিম বলেন, নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বৈষম্য বৃদ্ধির ফলে নারীরা কাজ কম পাচ্ছেন। যেসব নারী কাজ পাচ্ছেন, তারাও খুব মানসম্পন্ন কাজ পাচ্ছেন না। একই মানের কাজ করেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতার বিচারে পুরুষদের সমকক্ষ নন নারীরা—এমনটাই মনে করা হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। একজন নারীকে তারা ততক্ষণ সহ্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার ওপরে না ওঠেন। যখনই ওপরে উঠতে যান, তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও নানা সমস্যা।
লক্ষ্মীপুরের একটি কলেজের প্রভাষক সুলতানা মাসুমা রিতু বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহ আমার। আমি কবিতা লিখি ও আবৃত্তি করি। চাকরির পাশাপাশি মননশীল এ কাজে বাড়তি সময় ব্যয় করতে পারি না সহজে। পরিবারের নানান বাধা আর কৈফিয়ত আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
এডভোকেট আফরোজা ববি নামের একজন বলেন, এ সমাজের পুরুষরা আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কোন মূল্যায়নই করতে রাজি নয়। পুরুষরা আমাদের নারীদের প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে হয়রানি করে চলছে। টেলিফোন, এসএমএস, ই-মেইলের মাধ্যমেও হয়রানি করেন অনেক পুরুষ সহকর্মী।
লক্ষ্মীপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, সবার আগে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, তা না হলে এটি চলতে থাকবে। নারীদেরও সচেতন হতে হবে। কোনো সমস্যা হলে সেটি নিয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। নারী যেখানে কাজ করছেন, সেই প্রতিষ্ঠান না চাইলে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিষয় যেমন—প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বা নিপীড়ন বন্ধে আইন আছে, এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিপীড়নের বিষয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পলিসি থাকতে হবে, নারীরা যাতে অভিযোগ করতে পারেন ও তাকে যেন এ আশঙ্কা না করতে হয়, অভিযোগ করলে চাকরি চলে যাবে। মিডিয়ারও একটি জোরালো ভূমিকা আছে। মিডিয়া নারীদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতে পারে।