উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়া 

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কলকাতার সঙ্গে আমার প্রথম মোলাকাত উত্তর প্রান্তের জনপদ বেলঘরিয়ায়। দমদম বিমানবন্দরে নেমে নাগের বাজার মোড়ে এসে বামে মূল শহরে যাই নি। ডানে মোড় দিয়ে বিটি রোড ধরে ডানলপ, শিঁথি, বনহুগলি হয়ে চলে এসেছিলাম সোজা উত্তরের বেলঘরিয়ায়।

বেলঘরিয়া থানার সামনে সূর্যসেন হাসপাতাল পেরিয়ে আমাদের ঢাকার বিজি প্রেসের মতো বিরাট কম্পাউন্ড সরকারি ছাপাখানা স্বরসতী প্রেসের। তার সামনেই রথতলা। সেখানে শিক্ষাবিদ রূপালী রায়ের আমন্ত্রণে গিয়ে থেকে ছিলাম পাশেই, দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়ি লাগোয়া এক পান্থশালায়।

বিজ্ঞাপন

রথতলা থেকে পশ্চিম দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে বেলঘরিয়া রেলস্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেন ও বাসের পথ নৈহাটি, দমদম, উত্তরপাড়ার দিকে চলে গেছে।

প্রথম কয়েকদিন আশেপাশে প্রচুর হেঁটেছি। বেলঘরিয়া সংলগ্ন লোকালয় আর জনপদের ইতিহাস নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে হঠাৎই উঠে এসেছিল নজরুল-প্রসঙ্গ। বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ ঘেঁটে ও স্থানীয় প্রবীণদের স্মৃতিসৌজন্যে পেয়েছিলাম বেশ কিছু ঘটনা। 

বিজ্ঞাপন

নজরুলের দরাজ দিল যে বেলঘরিয়াকে আপন করে নিয়েছিল, জানার পর এক অদ্ভুত আনন্দ পেয়ে বসেছিল আমাকেও। কলকাতা বলতে সেই ঔপনিবেশিক শহর নয়, উপকণ্ঠের বেলঘরিয়াকেই আপন মনে হয়েছিল। সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' উপন্যাসের নায়িকার আবাসস্থলটিও মনে মনে খুঁজেছি তখন।

ইতিহাস থেকে এমনটিই জেনেছি যে, ১৯২৬-২৭ সালে, কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে নজরুল প্রায়ই হাজির হতেন বেলঘরিয়ায়। স্থানীয় বন্ধু ও কবিদের সঙ্গে আড্ডায় মজলিশে মেতে উঠতেন তিনি। স্থানীয় কবি চণ্ডীচরণের বাড়িতে জমে উঠত আড্ডা। এছাড়াও, কামারহাটি পৌরসভার কমিশনার বৈদ্যনাথ ঘোষালের বাড়িতে একটি সাহিত্যসভা আয়োজিত হত, নাম ‘রসচক্র’। নজরুল সহ কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা প্রায়ই আসতেন সেখানে। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সভার মধ্যমণি হয়ে উঠতেন নজরুল। 

নজরুলের জনপ্রিয়তা বেলঘরিয়া সহ আশেপাশের প্রতিটি জনপদেই ছিল তুঙ্গে। চণ্ডীচরণ মিত্রের উদ্যোগে বেলঘরিয়া মিডল ইংলিশ স্কুলে(বর্তমান বেলঘরিয়া হাই স্কুল) আয়োজিত বাৎসরিক ভোজ ও কবিসম্মেলনে নজরুল ছাড়াও গোলাম মোস্তাফা, নরেন্দ্র দেব, জলধর সেন, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, দীনেশ দাশ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখের উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। মূল কলকাতার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে কৌলিন্য ও সাহিত্য মেজাজ বজায় রাখতে বেলঘরিয়া পিছ পা হয় নি।

আরেকটি তথ্য পাই – অসুস্থ অবস্থায় নজরুল একবার আপনমনে বি টি রোড ধরে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ও গতিপথ সম্ভবত তাঁর নিজেরও জানা ছিল না। চল্লিশের গোড়ায় সেই শেষ-দুপুরবেলায় ট্রাফিকের ফাঁদে পড়ে লরিতে চাপা পড়বার মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁর। বেলঘরিয়ার পুলিশ চৌকিতে তাঁকে চিনতে পেরে নিয়ে যান ছাত্ররা। সেখানেই কবি বিশ্রাম করতে থাকেন। পরে খবর পেয়ে টেলার্স হোস্টেলের ছাত্ররা গিয়ে মোটরে কবিকে কলকাতার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

আমরা জানি, বুলবুল মারা যাওয়ার পরেই নজরুল মানসিকভাবে অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠেন। সাংসারিক অভাব, প্রমীলাদেবীর অসুস্থতা তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় আরও। যার পরিণতি এইসব মানসিক অস্থিরতাই যে তাঁকে বেলঘরিয়ার পথে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

১৯৪১এ মারা যান চণ্ডীচরণ মিত্র। ১৯৪২ সালে চিরতরেই অসুস্থ হয়ে গেলেন কবি নজরুল। বেলঘরিয়া ও পারিপার্শ্বিক আড়িয়াদহ, পানিহাটি, বরানগর প্রভৃতি জনপদের সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ সম্পর্কেও ছেদ পড়ে তারপর।

বেলঘরিয়ার পথে পথে সেইসব স্মৃতি ভীষণ নাড়া দেয়। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় থেকে মূল শহরের উত্তর প্রান্তের ব্যারাকপুর মুখী অতি ব্যস্ত বিটি রোডের (ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড) চলমানতার দিকে তাকালে স্মৃতির টুকরো টুকরো ছবি ভেসে আসে ইতিহাসের ঝাপসা পাতা থেকে। কলকাতার বেলঘরিয়া যেন ছোঁ মেরে নিয়ে যায় নস্টালজিয়ার কুয়াশা মোড়ানো প্রান্তরে। শিশিরের শব্দের মতো টুপটাপ ঝরায় অতীতের স্বর্ণরেণু। কলকাতার কথা ভাবলেই শুনতে পাই বেলঘরিয়ার মায়ারী স্পন্দন।