‘পোয়েট লরিয়েট’ হলেন না যে কবি!
ব্রিটেনের ইতিহাসে রাজকীয় কবি ‘পোয়েট লরিয়েট’ পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে অসম্মতি ও অপরাগতা প্রকাশের ঘটনা ইমতিয়াজ ধরকরই প্রথম ঘটালেন? নাকি অতীতে এমন সাহসিকতা অন্য কেউ দেখিয়েছিলেন, সে তথ্য এখনো কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে তার এমন সিদ্ধান্ত আলোড়ন তুলেছে লিটারেরি সার্কেলে। সবাই অবাক চোখে আরেক বার তাকাচ্ছেন এই দৃঢ়চেতা কবির দিকে। অতি সম্মত ও নমঃ নমঃ সমাজে ‘না’ করতে পারার সাহস ও ঋজুতার জন্য তিনি আদায় করেছেন শ্রদ্ধা ও সমীহ। বিশেষত, তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন একটি পদ, যা ঐতিহাসিক, বিশ্ববিশ্রুত এবং যে পদটি গ্রহণ করলে তিনি হতে পারতেন ইতিহাসের প্রথম এশীয়/প্রথম এশীয় নারী ব্রিটিশ রাজকীয় কবি ‘পোয়েট লরিয়েট’।
‘পোয়েট লরিয়েট’ হলেন না যে কবি, ইমতিয়াজ ধরকর দক্ষিণ এশিয়ায় জন্ম নিলেও এক বছরের কম বয়সে পিতামাতার সঙ্গে চলে আসেন ইউরোপে। বাস করতে থাকেন গ্লাসগোতে। তারপর ব্রিটেনের নানা জায়গায় শিক্ষা ও কর্ম উপলক্ষে থেকেছেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন লন্ডন, মুম্বাই। তবে সব সময়ই তিনি কাব্যচর্চা ও শৈল্পিক তৎপরতাকেই নিজের জীবনের প্রথম কাজ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং সে কাজেই নিমগ্ন থেকেছেন।
সমকালে ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান ও শ্রেষ্ঠ কবি রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ইমতিয়াজকে, যে কারণে তাকে তালিকার ওপরের দিকে স্থান দেয় রাজকীয় কবি ‘পোয়েট লরিয়েট’ খুঁজে বের করার কমিটি। তার কবিতা যে কেবল ব্রিটেনের স্কুল-কলেজ বা সাধারণ মহলে পাঠ্য, তাই নয়, ২০১১ সাল থেকে তিনি ‘রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার’-এর ফেলো। এই সোসাইটি যাকে-তাকে ফেলোশিপ দেয় না, বহু যাচাই-বাছাই করেই ফেলো নির্বাচন করে। ইমতিয়াজ ধরকর স্বকীয় যোগ্যতা ও কবি-কৃতিত্বে পদটি পেয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়, রয়্যাল ফেলোশিপের আগে তিনি হয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত সম্মানজনক ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’। কবি হিসেবে ট্র্যাক রেকর্ড ও ক্যারিয়ার এতোটাই ঝকমকে ইমতিয়াজ ধরকরের, যা তাকে রাজকীয় কবি ‘পোয়েট লরিয়েট’ পদের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবেই দাঁড় করিয়েছিল।
কিন্তু অতীতে অনেকগুলো পদে সম্মত হলেও ইমতিয়াজ ‘পোয়েট লরিয়েট’ পদটি গ্রহণ করলেন না। প্রথম বারের মতো অস্বীকৃতি জানালেন এমন একটি রাজকীয় পদ গ্রহণে, যা তাকে ঐতিহাসিক সম্মান ও রেকর্ডের অধিকারী করতো। এই ঘটনায় প্রমাণ হলো, তিনি প্রকৃতই একজন কবি। তিনি না বলেও যা জানালেন, তা হলো, শুদ্ধ সাহিত্যের বাইরে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করা কবির কাজ নয়। হট্টগোল ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্সেও তিনি যেতে চাইলেন না নিজের নিভৃতি ভেঙে। কারণ কবিতা রচনার জন্য তার চাই নিজস্ব টাইম, স্পেস ও সাইলেন্স।
নিজে ইতিহাস না গড়েও ইতিহাসের কাছে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় লিপিবদ্ধ করে রাখলেন ইমতিয়াজ। নিষ্ঠাবান একজন কবিকে কেমন করে পদ, পদবী ও পদকের মোহ ত্যাগ করে নিজের স্বকীয়তা, প্রাইভেসি রক্ষা করতে হয়, সে শিক্ষাটিই লিপিবদ্ধ করে রাখলেন কবি ইমতিয়াজ ধরকর।
ব্রিটিশ রাজকীয় কবি ‘পোয়েট লরিয়েট’ পদ গ্রহণে অসম্মত ৬৫ বছর বয়সী কবি ইমতিয়াজ ধরকর ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে, যে শহরটিকে বিবেচনা করা হয় দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্ররূপে। জাতিগত পরিচয়ে একজন পাঞ্জাবি হিসেবে তার সঙ্গে দেশ ও জনপদের অতীত-ঐতিহ্য বলতে রয়েছে স্বজনদের গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতিকথা, পূর্ব-পুরুষদের বয়ান আর নস্টালজিয়া। কারণ মাত্র এক বছরেরও কম বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে স্বভূমি ছেড়ে অভিবাসন করেন।
মাইগ্রেন্টদের প্রায়-সবাই যখন গ্রেট ব্রিটেনের মূল কেন্দ্রে বসতি গড়ছিল, ইমতিয়াজের পবিরার তখন বেছে নেন ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডের বদলে ওয়েলশ। গ্লাসগো শহরে বড় হলেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন বিলাতের অনেকগুলো নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ভারতেও আসা-যাওয়া করেছেন পড়াশোনা ও কাজের সূত্রে। তখনই তিনি বিয়ে করেছিলেন মুম্বাইয়ের অনিল ধরকরকে, যিনি একজন লেখক ও কবি। বিশেষত ‘মুম্বাই ইন্টারন্যাশনাল লিটারেরি ফেস্টিভ্যাল’ -এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক।
অনিল ধরকর মুম্বাইয়ে আন্তর্জাতিক কাব্য সন্মেলন ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে কবিদের নিয়ে কাজ করেন। তাদের কাব্য ও চর্চা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন নতুন কবিকে তুলে ধরেন। ‘রোমান্স অব সল্ট’ নামে একটি বইও আছে তার। চলচ্চিত্রেও অনিলের দখল আছে এবং কিছুদিন দিন তিনি লন্ডন, গ্লাসগোয় শিক্ষকতাও করেছেন, যার সঙ্গে ইমতিয়াজ জড়িয়ে ছিলেন প্রেমে, যাপনে, দাম্পত্যে। যে সম্পর্ক না টিকলেও ইমতিয়াজ পারিবারিক পদবী হিসেবে অনিলের কাছ থেকে প্রাপ্ত ধরকর ব্যবহার করেন।
ইমতিয়াজের একমাত্র সন্তান, কন্যা আয়েশা (জন্ম ১৯৭৭, মুম্বাই) অনিল ধরকরের সঙ্গে দাম্পত্যের ফসল। আয়েশা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, মঞ্চ নাটকে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের মধ্যে আয়েশা নাম করেছেন তামিল ছবি ‘দ্য টেরোরিস্ট’-এ অভিনয়ের নৈপুণ্যে। তার আরেক উল্লেখযোগ্য ছবি হলো ‘স্টার ওয়ারস’। কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত আয়েশা ২০১০ সালে পরিচালক-অভিনেতা রবার্ট টেইলরকে বিয়ে করে পুরোদস্তুর চলচ্চিত্রে-অভিনয়ে মেতে আছেন।
ইমতিয়াজ পরে বিয়ে করেন সাইমন পাওয়েলকে। সাইমন গ্লাসগো শহরে ‘পোয়েট্রি লাইভ’ নামে একটি সাহিত্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। ১১ বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০০৯ সালের অক্টোবরে এই কাব্যপ্রেমী মারা যান। একই শহরে ইমতিয়াজ ও সাইমন যৌথজীবনের শক্তিতে কবিতার জন্য কাজ করেছেন। সমগ্র ব্রিটেনের কাব্যচর্চাকে প্রভাবিত করতে এই যুগলের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তারা স্কুল, কলেজের সিলেবাসে কবিতার অন্তর্ভূক্তি, আধুনিক ও সমকালীন কবিতার বিকাশ, আলোচনা ও চর্চায় অগ্রণী অবদান রাখেন।
আরও পড়ুন: অবশেষে নতুন ‘পোয়েট লরিয়েট’