এটাও সত্য, লোকেরা আশেপাশের এলাকা থেকে নতুন জেগে ওঠা দ্বীপটাতে বসবাস করতে না এলে লুইগিদেরও আসবার অবকাশ তৈরি হতো না। কাজেই এক্ষেত্রে গ্রাম্য অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিতরাই ছিল পথপ্রদর্শক। সুবর্ণদ্বীপে এমনই প্রাণচাঞ্চল্য জেগে ওঠে, লোকে ভুলেই যায় যে এটি মাত্র কিছুকাল আগেও ছিল সমুদ্রের অভ্যন্তরে। লোকেরা তাদের পুরনো অভ্যেস ছাড়তে পারে না। ঘরে-বাইরে তারা নানা ঘটনার সূত্রে জড়িয়ে পড়ে বিবাদে-বিসংবাদে। ফলে আইন-আদালত দ্বীপটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বেশ তোড়জোড়ের সঙ্গে। অথবা এমনও হতে পারে, লোকেরা মোটামুটি বসবাস নিশ্চিত হওয়ার পরপরই যে-কাজটা শুরু করবে সেটা হলো আত্ম ও পারস্পরিক কলহ- কর্তৃপক্ষ তা আগেভাগে জেনেই সুবর্ণদ্বীপে আইনের শাসন নিশ্চিত করে। দ্বীপটিতে একটি কারাগার রয়েছে যেখানকার আসামিরাও তারাই যারা সুবর্ণদ্বীপের প্রথম দিককার বসতি স্থাপনকারী। নৌকা-লঞ্চই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভদ্র-ভদ্রেতর সবাইকে সুবর্ণদ্বীপে অবতরণ করবার সময় নৌকা-স্পিডবোট বা লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নামতে হয় প্রথমে কাদায় তারপর কাদামাটিতে এবং সবশেষে মাটিতে। ভাগ্য ভাল হলে তারা কলঙ্কমুক্ত বস্ত্রে দ্বীপে পৌঁছাতে পারে তা নাহলে কলঙ্কিত হয়েই উঠে আসতে হয় নদীতীর হতে। এটা কোন লজ্জা অলজ্জা বা মান-অসম্মানের ব্যাপার নয়। লঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে এম. এ. পাশ বা গ্র্যাজুয়েট সরকারি কর্মচারি চিৎ হয়ে কাদায় পড়ে গেলেও অধঃস্তন-তৎপরতায় তৎক্ষণাৎ সে ধরণি-উত্থিত হয় এবং তার ব্র্যান্ডের শার্ট-প্যান্ট রং বদলে কৃষ্ণকায় রূপ নিলে সে মনে-মনে ভাবে সুবর্ণদ্বীপের কাদায় কিন্তু গন্ধ মানে সে-অর্থে দুর্গন্ধ নেই। ঢাকা শহরের নর্দমার কাদায় যে-প্রাগৈতিহাসিক গন্ধ থাকে সেটা সুবর্ণদ্বীপের কাদায় চিন্তাই করা যায় না। বরং এই কাদা দেখলেই ইচ্ছে হয়, একটু গায়ে মাখি। মাঝে-মাঝে ছাপা হয় কাগজে, এমন পারমাণবিক যুগেও কাদা গায়ে মেখে সৌন্দর্যচর্চা করে বিশে^র সেরা সুন্দরীরা। অনেকে অবশ্য আজকাল চালাকির আশ্রয় নেয়। গোটা পথ পাড়ি দিয়ে দ্বীপের কাছাকাছি এলেই তারা পোশাক বদলে তার বদলে পরে নেয় নিতান্ত আটপৌরে ঘরোয়া পোশাক। লাগলে কাদা লাগুক ঘরের পোশাকে। বাইরের পোশাক অক্ষত থাকলেই হলো।
সেটা ছিল নিষ্ঠুর এপ্রিল মাস। এপ্রিল এর আগেও এসেছিল কিন্তু এমন নিষ্ঠুরতার ছাপ রেখে যায় নি। কয়েকদিন ধরেই প্রচারণা চলছিল, ভয়ংকর দুর্যোগের মেঘ জমছে সুবর্ণদ্বীপের আকাশে। লোকেরা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যায় সেজন্যে দিনভর মাইকে রেডিওতে টেলিভিশনে চলে ঘোষণার পর ঘোষণা। সমস্যা হলো, অধিকাংশ লোক সব ঘোষণা শোনে খুব মনোযোগ দিয়ে এবং তারা সেসব ঘোষণাকে উপেক্ষাও করে সচেতনভাবে। বিপদের কথা ভেবে আগাম স্থানত্যাগের অর্থ তাদের নিকটে নিজেদের অবলম্বন হারানো এবং সম্পদের মালিকানা অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। এর জন্যে অবশ্য তাদের দোষও দেওয়া কঠিন। বেশ কয়েকবার এমন দুর্যোগের ঘোষণায় সুবর্ণদ্বীপের অনেক লোক নিজ-নিজ জায়গা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঝড়ের পরে বাড়ি ফিরে তারা দেখতে পায় তাদের বাড়িঘর চোরেদের তৎপরতার পরিণামে শূন্যতা-আক্রান্ত। ফলত তারা দুই ঝড়-কবলিত হয়ে হায়-হায় করাঘাতে আর্তনাদ করে। সেই এপ্রিলেও অনেকেই আশ্রয় নেয় নিরাপদ বলে প্রতীয়মান প্রশাসন-চিহ্নিত স্থলে যদিও উঁচু জায়গা বলে তেমন কিছুই ছিল না সুবর্ণদ্বীপে যেহেতু সবটাই জেগে উঠেছিল সমুদ্রের গর্ভ থেকে। মধ্যরাতে শুরু হওয়া কয়েক ঘণ্টার ঝড়ো তা-বে সুবর্ণদ্বীপ প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে একদিনেই। ঢেউ এতটাই উচ্চতা ছোঁয় সাইক্লোন কেটে যাওয়ার পরে গাছে-গাছে মানুষ ও জীব-জন্তুর মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। কোন কোন পরিবারে মৃতদের জন্যে শোক করবার লোকও অবশিষ্ট থাকে না। সভ্য লোকেরা ভাবে, এত মৃত্যু কেন! যে-দ্বীপে মানুষই বসবাসের কথা নয় সেখানে মানুষ বসবাস করতে থাকলে তারা যে মূলত কবলিতই হবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেই সরল বাস্তবতাকে মেনে নিতে কষ্ট হয় মানুষের। যখন পত্রপত্রিকা ছিল না, যোগাযোগ এতটা বিস্তৃতজাল ছিল না তখনও এমন মৃত্যু ঘটেছিল এবং সেসব মৃত্যুর কোন হিসেব কেউ রাখে নি।
সুবর্ণদ্বীপের প্রায় সত্তর সতাংশ স্থলভাগ জলকবলিত হলেও সাইক্লোনের পরে যখন ফের সাম্যাবস্থা ফিরে আসে মানে দ্বীপের স্থলভাগ পরিপূর্ণভাবে পূর্বাবস্থায় রূপ নেয় তখন লোকেরা এত মৃত্যুর পরেও এই ভেবে আশায় বুক বাঁধে, না, সুবর্ণদ্বীপ আসলে নিশ্চিহ্ন হবে না, জেগে থাকবে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই। আবার লোকেরা আসে, আসে চারদিক থেকে- মূলত প্রতিবেশী অঞ্চল-জেলা থেকে। এসেই তারা মৃতদের শূন্যতা পূরণ করে নিতে থাকে দিকে-দিকে। চাষ-বাস ফসল-বাণিজ্য এইসব করণের প্রক্রিয়ায় আবার জীবন চতুর্দিকে বিস্তৃত হতে থাকে সুপরিসরে। এমন একটা হৃদয়বিদারক ঘটনা সুবর্ণদ্বীপের জন্যে অপকারী এবং উপকারী দুই ফল-ই বয়ে আনে। মৃত্যু ধ্বংস ক্ষয় প্রভূত অপকারের পরে আসে উপকারের দিন। এপ্রিলের নিষ্ঠুরতার কাহিনি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে দ্বীপটি পরিণত হয় আন্তর্জাতিক বিষয়বস্তুতে। বিশে^র বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় সুবর্ণদ্বীপের সাইক্লোনের প্রতিবেদন ছাপা হলে অনেক দেশ এগিয়ে আসে দ্বীপের ভবিষ্যতের মঙ্গল-সাধনে। অনেক ধনি দেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম স্থাপনা তৈরি করে দেয় দ্বীপটিতে। সেটা তারা করে শতভাগ নিশ্চয়তা সহকারে। তারা দেশটির কিংবা দ্বীপের লোকেদের ওপর আস্থা না রেখে নিজেরাই উপস্থিত থেকে নির্মাণ করে দেয় জরুরি স্থাপনাগুলো। তারা দেখে, যে-দেশের বইয়ে দুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে লোকেদের অপুষ্টিতে নিক্ষেপ করাটাও প্রকাশ্য বিষয়, যে-দেশের বইয়েতে জনসাধারণের প্রধান খাদ্যবস্তু চালের সঙ্গে পাথর মেশানোকে অনৈতিক না ভেবে বরং গণিতের হিসেবে শেখানো হয় সে-দেশের লোকেরা কালক্রমে শিক্ষিত হয়ে আরও-আরও অপকৌশল রপ্ত করে ফেলে। দুধ-পানি এবং চাল-কাঁকরের উন্নততর সংস্করণ হিসেবে তারা বেছে নেয় সিমেন্ট-বালি, এমনকি লোহার রড ও বাঁশের কঞ্চি। তারা আতঙ্কিত হয় ভেবে, যে-দেশের লোক গৃহসামগ্রিতে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের দুঃসাহস দেখাতে পারে তাদের বানানো আশ্রয়কেন্দ্রগুলির ঝড়-সাইক্লোনের পূর্বাভাসেই ধ্বসে পড়বার সম্ভাবনা। পরিণামে সুবর্ণদ্বীপের লোকেরা পায় মজবুত কিছু ভবন যেগুলো প্রচ- ঝড়েও উৎপাটিত হয়ে যাবে না।
লুইগিকে তাদের অনেকেই প্রথমটায় যাজক ভাবে। এর কারণ তার পরনে ছিল উর্ধাঙ্গে ফতুয়ার মত দেখতে ঢিলেঢালা ধরনের পোশাক এবং নিম্নাঙ্গে সুতির কাপড়ের ঢোলা পায়জামা। হয়তো আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই তার এমন পোশাক কিন্তু লোকেরা তাকে যাজকই ভাবে। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা গোলাম কবির নামের সহকারীটি লোকেদের সে-ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বলে, সুবর্ণদ্বীপের লোকেরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। এই প্রথম দ্বীপে একজন বিদেশি ডাক্তারের পদার্পণ ঘটেছে। লোকেরা এখন থেকে রোগেশোকে নিশ্চিত নির্ভরতা হিসেবে লুইগি পালোমারের কাছে গিয়ে নিজ-নিজ সমস্যার বিবরণ দিতে পারবে। অল্প সময়ের মধ্যেই লুইগির আগমনের সংবাদ রটে যায় সমগ্র দ্বীপে। যেসব লোক এরিমধ্যে অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে তারা বিদেশি ডাক্তারের নাম শুনেই আরাম বোধ করতে শুরু করে এবং অচিরেই লুইগির সাক্ষাৎ লাভের জন্যে মনে-প্রাণে অপেক্ষা করতে থাকে।
আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান
৩য় পর্ব আগামী শুক্রবার