করোনায় ঈদ: আনন্দের আবাহন, পুঞ্জিভূত বেদনা

, শিল্প-সাহিত্য

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 14:14:21

উৎসবের সঙ্গে ভোজের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর সর্বত্রই ধর্মীয় বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে থাকে খাওয়া-দাওয়া তথা ভোজের অঢেল ব্যবস্থা। উপমহাদেশে খাদ্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে কয়েক শত বছরের মুঘল শাসনে।

মুঘল হেরেমে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতির বিদগ্ধ রমণীরা এসে যোগ দিয়ে ছিলেন এবং তারা রন্ধনশিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ সাধন করেন। হুমায়ুন-পত্নী হামিদা বানু খানম ছিলেন শিয়া। মুঘল দস্তরখানায় তিনি এনে ছিলেন ইরান তথা পার্শিয়ান ডিস। অন্যান্য মুঘল রমণীগণ তাদের মধ্য এশিয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন করেন ভারতে। আকবরের অন্যতম মহিষী যোধা বাঈ মুঘল হেসেলে নিয়ে আসেন রাজপুতানার ব্যাঞ্জন। তবে পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিদুষী পত্নী নূরজাহান মুঘল খাদ্য তালিকাকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেন। বিরিয়ানি, রেজালা ইত্যাদি পদের উদ্ভব তার হাতে।

মুঘলদের খাদ্যরীতি পুরো উপমহাদেশের মতো বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং বহাল তবিয়তে খাদ্যতালিকায় স্থান লাভ করেছে। তদুপরি, এতিহ্যবাহী বাংলা হলো বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উৎসব বাঙালির জীবনে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আর উৎসবের কথা এলেই চলে আসে হরেক রকম খাবারের কথা। বিশেষ করে মিষ্টি। একফালি চাঁদের মতো ঈদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এরকমই একটি পদ— সেমাই। সেমাইয়ের পায়েস খেতে কে না ভালোবাসে! আর যদি সেটা ঈদের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যুগ যুগ ধরে এভাবেই মিলেমিশে গেছে এরা; তৈরি করেছে একটি নির্দিষ্ট ঘরানা।

হালকা বাদামি রঙের সরু সরু সুতোর মতো বস্তু। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা বলে গন্ধও বেরোয় অসাধারণ। তারপর দুধে ফেলে রান্না করলেই তৈরি পায়েস। আজ অবশ্য সেমাইয়ের ব্যবহার পায়েসেই আটকে নেই। অনেক রকম পদ, অনেক বাহার তার। তবে ঈদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খাটো হয়নি এতটুকুও। অনেক জায়গায় এই সেমুইয়ের পায়েস খেয়েই শুরু হয় ঈদ-উল-ফিতর।

এবার একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। এই সম্পর্ক যে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে চলে আসছে, তেমনটা নয়। ইতিহাসবিদরা বলেন, উনিশ শতক থেকে সেমাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ঈদ। তিরিশের দশক থেকে আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। একসময় এটা ঈদ উৎসবের অংশ হয়ে যায়।

মুঘল বা নবাবি আমলে এই সেমাইয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও তখন বহুবিদ বাহারি মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা হয়, সেমাই আরও প্রাচীন বলে গবেষকদের ধারণা। অনেকের মতে, গ্রিক ‘সেমিদালিস’ শব্দ থেকে সমিদা ও পরে অপভ্রংশ হয়ে সেমুই, সেমাই বা সামাই এসেছে। সে যাই হোক, সেমাই কিন্তু আদ্যোপান্ত ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। সহজে তৈরি করা যায় এবং দামে সস্তা— মূলত এই দুটো কারণের জন্য সেমাইয়ের এত রমরমা তখনকার মতো এখনও বহাল।

তবে শুধু ঈদেই নয়, ধর্মের বা উৎসবের বেড়া ভেঙে সেমাই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শুধু ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষেই নয়, বছরের অন্যান্য সময়ও তাড়িয়ে উপভোগ করা হয় এই খাবার। সেমাই খাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রস্তুত প্রণালীও। রয়েছে দীর্ঘ পরম্পরা। আজ অবশ্য সেখানে হানা দিয়েছে প্রযুক্তি। একটা সময় বাংলার বাড়িতে, গ্রামে-গঞ্জে হাতে ঘোরানো কলের সেমাইয়ের খুব প্রচলন ছিল। সবাই একসঙ্গে বসে তৈরিও করত সেসব। এখন আর সেই রীতি দেখা যায় না। দেখা গেলেও, সংখ্যায় খুবই কম। আধুনিক মেশিনেই তৈরি হয় লোভনীয় সেমাই। আস্তে আস্তে পেছনে পড়ে যাচ্ছে হাতে ঘোরানো কলের সেমাই।

করোনা ও নানা দুর্যোগের মধ্যেই এসেছে আরেকটি খুশির ঈদ। এসে গেছে সেমাই ও নানা উপাদেয় খাবারের মরসুমও। কালিয়া, কোর্মা, রোস্ট, বিরিয়ানি, ফিরনি, পায়েস ইত্যাদি নানা আইটেমে ভরপুর হবে ডাইনিং টেবিল। ঈদ ও উৎসবের দিনগুলোতে প্রতিটি মানুষ সাধ্যমতো চেষ্টা করবে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে একটু ভাল খাবার-দাবার উপভোগের জন্য। কিন্তু করোনা বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে গত বছরের মতো এ-বছরেও মানুষে সাধ্য সীমিত হয়েছে। সব জায়গায় এখন ভীতি, বন্দিত্ব, ধ্বংস, হাহাকারের ছবি। কোথাও আলো নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই। আবার কোথাও আবার আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও চিরচেনা, একান্ত মানুষটাই নেই।

তারপরও ঈদ এসেছে আনন্দের আবাহনে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে করোনাকালের পুঞ্জিভূত বেদনা। বুকচাপা বেদনা-বিষাদ নিয়েই মানুষ পালন করছে উৎসব। মৃত্যু, আক্রান্ত ও যন্ত্রণাকে চেপে সবাইকে নিয়ে ভালো-মন্দ খাওয়ার চেষ্টা করছে। যে হাসিটা করোনার তীব্র আঘাতে মুছে যাচ্ছে, উৎসবে, আহারে, আনন্দে মহিমান্বিত ঈদ আবার ফিরিয়ে আনছে সেই অমলিন হাসি আর অপার্থিব আনন্দ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর