বহুমাত্রিক মুসা আল হাফিজ

, শিল্প-সাহিত্য

সাঈদ চৌধুরী | 2023-09-01 21:41:10

বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষিত সমসাময়িক লেখকদের মাঝে মুসা আল হাফিজ বোধহয় সবচেয়ে ‘বহুপ্রসূ’। উর্বর, সুপ্রচুর, ফলপ্রসূ ইত্যাদি অর্থ বুঝাতে ‘বহুপ্রসূ’ শব্দটি যথার্থ বলে মনে হচ্ছে। সাহিত্যে আরেকটি ব্যাপক ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘সব্যসাচী’। উভয় হস্তে সমান কাজ করতে সক্ষম ব্যক্তি। একসাথে নানাবিধ কর্মসম্পাদন করেন এমন ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়। এজন্য সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শীদের সব্যসাচী লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কবি ও গবেষক মুসা আল হাফিজ এমন একজন সব্যসাচী লেখক। কবিতা, ছড়া, কথাশিল্প, গবেষণা, অনুবাদ, জীবনী, সাহিত্য সমালোচনা, শিশুতোষ ইত্যাদি প্রকরণে তিনি হেঁটেছেন। তার বিষয়ের মধ্যে আছে দর্শন, সমাজ, সংস্কৃতি, আন্তঃসভ্যতা, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যবাদ, অধিবিদ্যা, সীরাত, তাসাউফ ইত্যাদি।

বৈচিত্রে ভরপুর তার লেখাসমূহ ইতোমধ্যে সুধীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সারা দেশে এবং দেশের বাইরে শিক্ষিত তরুণদের অনেকেই তার দ্বারা প্রভাবিত হলেও বিশেষ অর্থে মাদ্রাসা পড়ুয়া একঝাঁক তরুণ দারুণভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। তারা প্রভাবিত হচ্ছেন চেতনে-অবচেতনে। ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইলমে ফিকহ, সিরাত শাস্ত্র এবং সাংবাদিকতায় মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রেখেছেন অসাধারণ অবদান। মাদ্রাসা অঙ্গনে লেখক অনেকেই আছেন বটে। কিন্তু মদীনা সম্পাদক ইন্তেকালের পর জাতীয় জীবনে মনন ও সৃজনচর্চার মূলধারায় যে শুন্যতা দেখাদিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে মুসা আল হাফিজ আলোকবর্তিকা হিসেবে আশাবাদ জাগিয়ে তুলেছেন। তার লেখায় সামাজিক বাস্তবতা ও সমকালীন যুগযন্ত্রণা পরিস্ফুটিত হচ্ছে শিল্পসম্মত ভাবে। গবেষণাধর্মী ও তাত্ত্বিক প্রবন্ধের জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের কোটা অতিক্রম করেছে।


তাত্ত্বিক পরিসরে বাংলাভাষায় আধুনিক শিক্ষার সাথে ইসলামী শিক্ষার, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদী ভাবনার বিপরীতে ইসলামী মূল্যবোধকে শিল্পসম্মত ও বৌদ্ধিক উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন মুসা আল হাফিজ। তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরছেন তার অভিমত, মতামত। লিখছেন হৃদয়গ্রাহী কবিতার পংক্তিমালা। প্রকাশভঙ্গিতেও নাগরিক মননের ছাপ আছে। আধুনিক শিক্ষিত ও বিদগ্ধজনের কাছে শুধু মাদরাসায় শিক্ষিত একজন লেখকের মাঝে এতগুলো জ্ঞানের সমাহার বেশ আশ্চর্যের বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।

মুসা আল হাফিজ ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলামী দাওয়াহ ও গবেষণা কেন্দ্র ‘মাহাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়া’। সেখানে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলামী দর্শন, সিরাত ও ইতিহাস এবং আধুনিক দুনিয়া ও ইসলামী জীবনাদর্শের পর্যালোচনামূলক পাঠদান করেন। এছাড়া আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অতিথি শিক্ষক হিসেবে দিচ্ছেন উচ্চতর পাঠ। সিলেটে ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জামেয়াতুল খায়র আল ইসলামীয়া’র সাথেও যুক্ত রয়েছেন। সেখানে তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ২০১৬ সালে যোগদান করেন।


শিক্ষা জীবনে মুসা আল হাফিজ কৃতীত্বের সাথে তাকমিল ফিল হাদীস সম্পন্ন করেন ২০০৭ সালে। তাফসীরুল কুরআনে বিশেষজ্ঞ কোর্স করেছেন ২০০৮ সালে। তারও আগে মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৯৫ সালে তিনি পবিত্র কুরআন ‘হিফজ’ করেন।

সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের মাখরগাঁও গ্রামে ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহন করেছেন মুসা আল হাফিজ। ২০০৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ আলেম প্রতিভা হিসেবে সম্মানীত হয়েছেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বিশ্বনাথ জামেয়া মাদানিয়ায়। সেখানে সাত বছর তাফসীর, হাদীস এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যের পাঠদান করেছেন।

২০১১ সালে কবি মুকুল চৌধুরী ‘মুসা আল হাফিজ : কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর’ লিখে পাঠকের ভাবের দুয়ারে নাড়া দিয়েছেন। এরপর তিনি লিখেছেন ‘আরো তিন কবি ঐতিহ্যের মেধাবী উত্তরাধিকার’। কবি নিজামউদ্দীন সালেহর লেখা ‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’, কবি সোলায়মান আহসানের ‘নক্ষত্রের বিলাসিতা’ এবং কবি মুসা আল হাফিজের ‘ঈভের হৃদের মাছ’ এই তিন কাব্যকে উপস্থাপন করেছেন আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি মুকুল চৌধুরী।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. রিজাউল ইসলাম ২০১৮ সালে লিখেছেন গবেষণাগ্রন্থ ‘মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব’। তার কবিতা ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিভিন্ন সময় লিখেছেন কবি আল মাহমুদ, ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী, কবি আল মুজাহিদী, কবি আসাদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খানসহ বরেণ্য অনেক সাহিত্যিক-সাংবাদিক।

আপন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমকালীন যেসব প্রতিক্রিয়া তিনি তৈরী করেছেন, তার নমুনা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কবি আল মাহমুদের মূল্যায়নকে উল্লেখ করাই প্রশস্ত। তার কবিতা প্রসঙ্গে আল মাহমুদ লিখেন- অসাধারণ কবি থাকেন খুবই কম। একটি জাতির হাজার বছরের পূণ্যে একজন অসাধারণ কবি জন্ম নেন। আমি দীর্ঘ দিন ধরে অসাধারণ কোনো কবিতার গন্ধ শুঁকতে উন্মুখ হয়ে আছি। বাংলা কবিতার শরীর হাতড়াচ্ছি অসাধারণ সৃষ্টি বেদনার লক্ষণের আশায়।


এসময় যাদের কলমে বৈশিষ্টমণ্ডিত কবিতার বীর্য রয়েছে, তাদের মধ্যে শক্তিমান এক কবি মুসা আল হাফিজ। মুসা আল হাফিজ যে শক্তিমান, তার স্বাক্ষ্য ঈভের হ্রদের মাছ কাব্যে রয়েছে। সত্যিকার কবি হৃদয় নিয়ে তিনি এ গ্রন্থে আবির্ভূত হয়েছেন। আমি এতে প্রকৃত কবিতার এই আকালে তার প্রতি বড় আশার দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। কারণ মানুষ ও মানুষের পৃথিবীর জন্য সবচে’ জরুরী যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের স্বচ্ছল আনন্দে অবগাহন করে বিদ্যুচ্ছমকের মতো উজ্জল দৃশ্য ও বাক্য নির্মাণে মুসা আল হাফিজ পারঙ্গম। তার শব্দ ও বিষয় সচেতনতা উচ্চমানের। গভীর আধ্যাত্মিকতার রহস্য তৈরীতে তার প্রচেষ্টা নিয়োজিত হয়েছে। আমি এতে বৈদগ্ধ ও শিল্প সাফল্যের চিহ্ণ লক্ষ করেছি। ডান-বাম মিলিয়ে এই প্রজন্মের তরুণ কবিদের মধ্যে মুসা আল হাফিজের কবিতায় সবচে সবলভাবে প্রাণের স্পন্দন শুনা যায়। তার দেখার তৃতীয় চোখ অন্তর্ভেদী বলেই মনে হলো। তিনি দেখেছেন ‘বাতাসের ঢেউয়ে ভাসে পর্বতের পাঁজরের গুঁড়া’ ‘প্রকৃতির গলিত পুঁজে ভরে যাচ্ছে ইথারের ঝিল।’ তার সাহসী উচ্চারণ ‘মৃত্যুর বুকে আমি পা রাখলেই পৃথিবীর বিজয় উৎসব’।

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, মুসা আল হাফিজের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। বর্ণিল এক আলোকপিয়াসী চৈতন্যের ভাষ্যকার তিনি। তার সপারগ হাত চলমান অবক্ষয়ের বিপরীতে হৃদয়ের সওদা বিতরণ করছে। মানুষের পরম সত্তাকে জাগ্রত করার জন্য যে প্রেম ও শিল্প এই কবির অন্বেষা, তা আজ মানবতার বড়ই প্রয়োজন। তার দীপান্বিত বোধ যে অমৃতময় উত্মসবের দিকে যাত্রা করে, সেই যাত্রাপথ ঐশ্বর্য-সম্ভারে সমৃদ্ধ।

সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মুসা আল হাফিজ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: উলুমূল কুরআন জাতীয় পুরস্কার (২০০৮), গ্রেটার সিলেট সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫), ফররুখ আহমদ জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার (২০১৯), জাতীয় কবিপরিষদ সাহিত্য পদক (২০১৯), বাসাসপ সাহিত্য পুরস্কার (২০২০), জালালাবাদ সাহিত্য পুরস্কার (২০২০), জাতীয় সীরাত পদক (২০২২) ইত্যাদি।


মুসা আল হাফিজের বেশ আলোচিত গ্রন্থ হচ্ছে- বাংলাদেশ ও ইসলাম : আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্স, কালামদর্শ’, পৃথিবীর ঘরে ফিরো, মনের উপনিবেশ মনের মুক্তি, বিষগোলাপের বন, হৃদয়াস্ত্র, জন্ম-মৃত্যুর সিগনেচার, মৃত্যুর জন্মদিন ইত্যাদি।

বাংলাদেশ ও ইসলাম: আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্স: ইসলাম ও বাংলাদেশ, ইসলাম ও বাংলাভাষা : আত্মীয়তার বন্ধন কতোটা? এই ভূমি, ভাষা ও জনগোষ্ঠীর হয়ে ওঠার সাথে ইসলামের যোগসূত্র কেমন? ইসলাম এখানে আসার আগে কেমন ছিলো এই দেশ, ভাষা ও বাঙালি? ইসলাম এসে কীভাবে এর সমৃদ্ধি ও বিকাশে ভূমিকা রাখলো? কীভাবে মুসলিমদের হাতে নিশ্চিত হলো বাংলা ভাষার নবজন্ম, বাংলা নামের দেশের গঠন?

বইটিতে প্রামাণ্যতা, যুক্তিশীলতা ও মুক্তপর্যালোচনা করেই মুসা আল হাফিজ আলোকপাত করেছেন আপন বিষয়ে। এতে খারিজ হয়েছে ইতিহাসের নামে প্রচলিত বহু গুজব, বহু মিথ্যা। যেমন বখতিয়ার খিলজির হাতে নালন্দা আক্রমণের গুজব, মুসলিম বিজয়ে অন্ধকার যুগের সূচনার মিথ্যাচার। বইটিতে বাংলা ও বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র অনুসন্ধান করা হয়েছে শাড়ে তিন হাজার বছরের পথপরিক্রমায়। অনেকেই দেখাতে চান, ইসলাম ও বাঙালি পরিচয়ের বিরোধ। মুসা আল হাফিজ প্রমাণ করেছেন এ তত্ত্বের অসারতা। বইটির গুরুত্ব শুধু ঐতিহাসিকতায় নয়। আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার ক্রমধারাকে নতুন দৃষ্টিতে বিচার করার সুযোগ করে দেবে এ বই।

কালামদর্শন: বইটি বেশ শক্তিশালী। এর শক্তির মূলকথা হলো চিন্তা। চিন্তা এক মানসিক শক্তি। এর মাধ্যম ইন্দ্রিয়। কিন্তু কালাম দর্শনের চিন্তার মাধ্যম শুধু ইন্দ্রিয় নয়, স্বজ্ঞা এবং এরপর ওহী অবধি। বাংলার দার্শনিকতায় বরকতুল্লাহ, আবুল হাশেম, দেওয়ান আজরফ সজ্ঞাকে মেনেছেন প্রধান মনুষ্য জ্ঞানহাতিয়ার। আল্লামা ইকবালের প্রভাব ছিলো তাদের অস্তিত্বজুড়ে। মুসা আল হাফিজও ইকবালের অনুরাগী। তবে তার মানসিক বিচরণভূমি কালামের গোটা পরিসর। চিন্তার প্রক্রিয়ায় চারপাশের প্রকৃতি ও প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে তার সাথে স্বজ্ঞা ও ওহীর আত্মীয়তা দেখানো তার দার্শনিকতার অন্যতম ধরণ। অভিজ্ঞতাজাত ধারণাগুলিকে পরস্পরের সাথে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ এবং সেগুলিকে একত্রিকরণ বা পারস্পরিক সংযুক্তিকরণের জরুরী চেষ্টার ইসলামজাত একটি নিদর্শন এই কালামদর্শন।

বইটির বাক্যসমূহ সরল-সহজ। তবে এর অবধারণ অনেক গভীর। অবধারণ থাকে চিন্তা ও ভাষার মাঝখানে। এ হচ্ছে ভাষার মানসিক রূপ বা ভাষার হয়ে ওঠার পর্ব। অবধারণগুলি মুখের ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকে না, আচরণ বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। কালামদর্শনের গোটা আদল, বিন্যাস, বিচার, সংগঠন মিলিয়ে যে অবধারণ তৈরী হয়, সেটার আয়তন অনেক বড়।


অবধারণের পরের স্তর হলো ভাষা। এ বইয়ে ভাষাটাও গুরুত্বপূর্ণ। একদম হৃদয় ও চিন্তা দিয়ে লেখা। জ্ঞানকে যদি হৃদয়ের কলমে, চিন্তার হাত দিয়ে লেখা হয়, কেমন হবে সেই লেখা? কালামদর্শনে তেমন লেখা আসলে। বইটির বিষয় ইসলাম বিশ্বাসের তত্ত্ব এবং মুসলিম চিন্তা ও চিন্তার উপাদানগুলির বোঝাপড়ার পরম্পরার সাথে সম্পর্কিত। কালাম ও দর্শনকে একত্রিত করে ইসলামের জ্ঞানসম্পদের তাত্ত্বিকতার বয়ান বইটিতে ক্রমাগত হাজির হয়। এর আধুনিক প্রস্তাবনা ও ধারণা (CONCEPT) উপস্থাপন করা হয়।

পৃথিবী ঘরে ফেরো: আরেকটি আলোচিত গ্রন্থ। সমকালীন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতার নানা দিক এ গ্রন্থে আলোচিত। গ্রন্থটি রচিত হয় ওয়ার অন টেররের দাউদাউ পরিস্থিতিতে। মুসা আল হাফিজ প্রশ্ন তুলেন- প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। তাদের কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ অন্যের গুলিতে নিহত হয়। এছাড়া সরকারী পরিসংখ্যান মতে, দেশটিতে প্রতি বছর বন্দুকের গুলিতে ১ হাজার ৩০০ শিশু মারা যায়। কারা এই নিষ্ঠুরতার হোতা? তাদের ধর্ম পরিচয় রবাবরই আড়াল করা হয়। আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ এই সকল তথ্য জানে না। উল্টো পৃথিবীর কোথাও কোনো হত্যাযজ্ঞ ঘটলে ইসলামকে কালো বিড়াল বানানো হয়। এমন অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে ‘পৃথিবী ঘরে ফিরো’ গ্রন্থে। বইটি মূলত তার কলাম ও প্রবন্ধ সংকলন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ থেকে নিয়ে আলী নদভী, রেনল্ড দ্য চেটিলন থেকে বখতিয়ার খিলজি, ইকবাল থেকে সৈয়দ আলী আহসান, দর্শন থেকে ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি, ক্রসেড থেকে সন্ত্রাসবাদ-পুজিবাদ-জায়নবাদ, শ্রমশোষণ, গ্রিনহাউস ইফেক্ট, মানবতার বিপণ্ণতা, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।

মনের উপনিবেশ মনের মুক্তি: বি-ঔপনিবেশিকতা নিয়ে মুসা আল হাফিজের বয়ান আলাদা। জ্যাক দেরিদা, ফ্রানৎস ফাঁনো, মিশেল ফুকো, নোয়াম চমস্কি কিংবা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর ভাষা ধার করে বি-উপনিবেশের তাত্ত্বিক বয়ান তৈরির মধ্যে আরেক ধরনের উপনিবেশ থাকে, যার নাম ইউরোপকেন্দ্রিকতা। কোনো কোনো মুসলিম বুদ্ধিজীবী এ ধারায় কথার ওপর কথামালা সাজিয়েছেন। তাদের ভাষ্যের অন্তঃসারশূন্যতা চোখে চোখ রেখে দেখিয়ে দেন মুসা আল হাফিজ। ইউরোপকেন্দ্রিকতার বাইরে গিয়ে ঔপনিবেশিকতার মোকাবিলার আদর্শিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাণীভাষ্য কী হবে, কেমন হবে- সে ইশারা আছে তার ‘মনের উপনিবেশ মনের মুক্তি’ গ্রন্থে। একজন স্বাধীন চিন্তকের বিশ্বাসী চোখ কীভাবে চলতি পৃথিবীর অধিপতি চিন্তা-স্রোতকে উপেক্ষা করে এবং মুক্তির পথ প্রস্তাব করে, তার লেখ্যচিত্র দেখা যেতে পারে মুসা আল হাফিজের এই গ্রন্থে।

বিষগোলাপের বন: পথ দেখানোর দায়িত্ব নেয় না বিষগোলাপের বন; কেবল চোখ খুলে দেওয়ার কাজটি করে। যেন আপনি নিজেই দেখে নিতে পারেন আপন পথ। বইটি কোনো চিন্তাপুঞ্জের বয়ান নয়; বরং এর মধ্যকার প্রতিটি কথা এমন এক চিন্তাপুঞ্জের দরজা খুলে দিতে চায়, যাতে জীবন ও জগতের রহস্য সন্ধানে আপনি নিজেই জ্ঞানগতভাবে প্রস্তুত ও সক্ষম হতে থাকেন। ধর্ম ও কর্মের বিচিত্রমুখী দার্শনিক বয়ানে কবি মুসা আল হাফিজ অবলম্বন করেছেন টুকরো কথনের ভঙ্গি। প্রতিটি টুকরোর ভেতরে আছে বিশ্লেষণের একেক জগৎ, অনুভবের একেক দরিয়া।

হৃদয়াস্ত্র: মানুষের মূল্য, জীবনের ব্যবহার, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সংকট, প্রকৃতির বৈচিত্র্য- ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি আত্মার রহস্য, বিশ্বাসের তত্ত্ব, সত্যসন্ধানের সৌন্দর্য, ধ্যানের জীবন্ত অভিজ্ঞতা ইত্যাদি একাকার হয়েছে এ বইয়ে। দার্শনিক আলোচনা ও প্রবচনগুলো ভাবনার জগতে নতুনত্ব যোগে আমাদের করে তুলেছে কৌতূহলী। মানব কৌতূহল উস্কে দিয়ে তিনি জ্ঞানের পসরা সাজান। আজকের তাজা বিষয় ও ভাবনাগুলোর সঙ্গে দর্শনের নিবিড় সম্পর্কের দূতিয়ালি করেন। মুসা আল হাফিজ সমসাময়িক বিষয়ে দার্শনিক ভাবনা তথা নতুন নতুন চিন্তাকে মূল্য দিতে চান। বিশ্বব্যবস্থায় দর্শনের তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ ও কার্যকারিতার পাশাপাশি নতুন দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্র ও জ্ঞানের জগৎকে অধ্যয়ন করতে চান। চিন্তা তার কাছে শুধু বিমূর্ত জ্ঞান নয়, একে নীতিবিদ্যার পোশাকে সংক্ষিপ্ত বাক্যের পরিসরে জীবনঘনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছেন হৃদয়াস্ত্র গ্রন্থে।

জন্ম-মৃত্যুর সিগনেচার: স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা ও সতেজ অভিব্যক্তিতে টইটম্বুর একটি চিত্তের জাগর উদ্ভাসন ‘জন্ম-মৃত্যুর সিগনেচার।’ সত্য যেখানে ধ্রুব। ন্যায় যেখানে অন্বিষ্ট। প্রেম যেখানে প্রপূর্ণ। বিশ্বাস যেখানে প্রোথিত। প্রশ্নশীল আত্মার শান্ত শামিয়ানাটি যেখানে মুক্ত উদ্বেল ও অবারিত এবং ঐকান্তিক অভিজ্ঞানে উন্মোচিত। এই গ্রন্থের উচ্চারিত প্রতিটি ধ্বনি আপনাকে নিয়ে যাবে পুনর্বার স্বয়ং আপনার কাছেই। যে আপনি সত্যি ঘুমিয়ে আছেন অথবা জেগে থেকেও আরো বিস্ময়কর আলস্যে খেইহীন দিগ্সন্ধানী অথচ স্বপ্নশীল উত্তাল উন্মাতাল; তাই এই বই আপনার জন্য একটি অভাবিতপূর্ব জীয়নকাঠি।

প্রিয় পাঠক, আপনি জ্বলে উঠবেন এবং আপনাকে জ্বলে উঠতেই হবে এই বইয়ের মর্মবাণীর সৌম্যস্পর্শে। এ বই আপনার মর্মলোকের শেকড়ে পানি সিঞ্চন করে। যার সুফল পেতে থাকবে জীবন ভাবনার প্রতিটি ডাল-পালা। ফলে এ বইকে কোনো এক বিষয়ের গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে আমাদের বোধ ও বুদ্ধি এবং হৃদয় ও মনকে সে আলোকিত করার প্রদীপ জ্বালায়।

মৃত্যুর জন্মদিন: একটি কবিতার বই। এ হচ্ছে হৃদয়ের রক্তবৃষ্টি, অস্তিত্বের শানে নুযুল, অস্তিত্বের তর্জমা, অস্তিত্বের তাফসির। মৃত্যুর জন্মদিন। কী আছে এখানে? এখানে আত্মার রক্তপাত। এখানে সময়ের গলিত মগজ। এখানে পাখি ও নদীর রোদন। এখানে সময়ের শিরার আগুন লকলকিয়ে বিষ হয়ে ঝরে পড়ে নিরব নর্দমায়। এখানে একজন লোক প্রদীপ হাতে সারা দিন আলো খোঁজে দিনের আলোয়। শত শত ঘটনা ঘটে চলে এখানে। কাল হয়ে যায় একটি স্থিরচিত্র। পাগলা শতাব্দীকে বগলদাবা করে ইতিহাসের উজানে দৌড়াতে থাকে প্রতিটি শব্দ।

মুসা আল হাফিজের রচিতগ্রন্থসমূহ-

কবিতা: ১. মুক্তি আনন্দে আমিও হাসবো (২০০২), ২. ঈভের হ্রদের মাছ (২০১০) ৩. পরম সাঁতার (২০১৭) ৪. মৃত্যুর জন্মদিন (২০১৯) ৫. ১০০ কবিতা (২০২২)

গবেষণা: ৬. সভ্যতার সংঘাত ও মুসলিম বিশ্বের যাত্রাপথ (২০০৫) ৭. প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ (২০১৫) ৮. আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার (২০১৭) ৯. সহস্রাব্ধের ঋণ (২০১৮) ১০. মুক্তিযুদ্ধ ও জমিয়ত (২০২০) ১১. সিলেট নগর উন্নয়ন : একটি রূপরেখা (২০১৮) ১২. মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন : একটি পর্যালোনা (২০১৭) ১৩. ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন, প্রেক্ষিত একুশ শতক (২০০৯) ১৪. বাংলাদেশ ও ইসলাম আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্স (২০২১)

জীবনী: ১৫. মহাকাব্যের কোকিল- মহাকবি আবদুর রহমান জামী (২০১৪) ১৬. মরমী মহারাজ- হুসাইন ইবনে মনসুর হাল্লাজ (২০১৫) ১৭. মহাসত্যের বাঁশী- জালালুদ্দীন রুমী (২০১৬) ১৮. মহাকালের মধু শেখ সা'দী (২০১৭) ১৯. শতাব্দীর চিঠি- নূর কুতবুল আলম (২০১৯) ২০. চেতনার চিকিৎসক- শায়খ তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী (২০২০)

সাহিত্য সমালোচনা: ২১. দৃশ্যকাব্যে ফররুখ আহমদ (২০১৭) ২২. চার কবি : চিত্তের পাসওয়ার্ড (২০১৯)

প্রবন্ধগ্রন্থ: ২৩. মাদক : মায়াবী মরণাস্ত্র (২০০৬) ২৪. আমি বিজয়ের সন্তান (২০০৬) ২৫. পৃথিবী ঘরে ফিরো (২০১৭) ২৬. ভাবনার বীজতলা (২০১৯) ২৭. ‘ঈশ্বরের মৃত্যু‘ ও অন্যান্য (২০২২) ২৮. বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা (২০২২) ২৯. স্রষ্টারে দেখে সৃষ্টিরে দেখি (২০২১)

ছড়া: ৩০. সৃজনে রক্ত চাই (২০০৬) ৩১. থাপ্পড় (২০১৮) ৩২. কানমলা (২০১৯)

শিশুতোষ: ৩৩. দুধের নদী (২০১৮) ৩৪. জীবনজয়ের গল্প (২০১৫) ৩৫. নতুন পৃথিবীর দর্শন (২০০৯) ৩৬. পাশ্চাত্য দর্শনে মুসলিম অবদান (২০১৭) ৩৭. নক্ষত্রচূর্ণ (২০২০) ৩৮. বিষগোলাপের বন (২০২০) ৩৯. হৃদয়াস্ত্র (২০২১)

অনুবাদ: ৪০. তৃতীয় সহস্রাব্ধের কিয়ামত (২০০৯) ৪১. যে সূর্যে প্রদীপ্ত বিশ্ব, সে তুমি আলিম (২০০৭) ৪২. হিদায়াতুল ইরফান (২০১৮)

আলোচনাগ্রন্থ: ৪৩. তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব : ইসলামী উত্তরাধিকার (২০১৯) ৪৪. দুঃসময়ের বধ্যভূমিতে উত্থানের চাষাবাদ (২০২০) ৪৫. জাতিগত বিজয়ের অদৃশ্য কারিগরি (২০১৯) ৪৬. আল্লাহকে যে পাইতে চায় (২০২১)

সীরাত : ৪৭. রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম খণ্ড ৪৮. মহানবীর সা. জীবনপঞ্জী

প্রকাশিতব্য : ৪৯ .রাসুলুল্লাহ (দ্বিতীয় খণ্ড) ৫০. দ্রষ্টব্যের ধারাভাষ্য (প্রবন্ধ) ৫১. উত্তরাধুনিক শরাব (জীবনভাবনা) ৫২. আত্মগত দার্শনিক (উপন্যাস)

বহুমাত্রিক লেখক, চিন্তক ও কবি মুসা আল হাফিজকে নিয়ে শীঘ্রই বড় পরিসরে লিখবো ইনশাআল্লাহ। তার বইগুলো আপনার সংগ্রহে রাখুন। প্রিয়জনকে উপহার দিন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর