(পূর্ব প্রকাশের পর) উপাচার্যের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে, যেখানে বেশ কয়েকটি আলমারিতে নজরুলের সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে। রয়েছে প্রায় চার হাজার গানের স্ক্রিপ্ট। এছাড়া দুটো কলের গান দেখতে পেলাম, যেগুলোতে নজরুল একসময় গান শুনতেন। দু’একটা বাদ্যযন্ত্রও ছিল মনে হয়। কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম কবিতীর্থ চুরুলিয়ার পথে। এর মধ্যে ভদ্রলোক জানিয়ে রাখলেন তিনি চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমিতে বলে রেখেছেন আমাদের কথা, ‘অতএব আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না’।
একাডেমির দেখভাল বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। চুরুলিয়ায় পৌঁছে অবাক হলাম নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র একজন এখনো জীবিত আছেন, যে কথাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ বলেননি। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখানে আমাদের লোক আছে, নজরুল একাডেমি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ইত্যাদি অনেক কথাই জানালেন। অথচ ওখানে যে নজরুল পরিবারের একান্ত আপনজন রয়েছেন সেটি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গেলেন! এটি জানা থাকলে কুড়ি কিলোমিটারের পথ আমাদের নিকট হয়তোবা দুই কিলোমিটারে দাঁড়াত!
আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার পথে একধরনের উত্তেজনা নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত নজরুলের স্ট্যাচ্যুর সাথে ছবি নিতে ভুল হলো না। কুড়ি কিলোমিটার খুব বেশি দূর তো নয়। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম। দু’জন সাধারণ চেহারা ও বেশভূষার মানুষ আমাদের দেখা মাত্র সাথে নিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপারে বসে আছেন শ্যামল বরণ, বলিরেখামণ্ডিত চেহারা, চশমা পরিহিত প্রায় আশির অধিক বয়েসি এক ভদ্রলোক। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ওটা ঠিক সাদা ছিল না, বহুল ব্যবহারে মলিন হয়ে পড়েছে আসল রঙ। আর চশমার ওপারে চোখ দু’টি কি ঘোলাটে ছিল ? আমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তিনি, কাজী রেজাউল করিম, নজরুলের কনিষ্ঠ ভাই আলী হোসেনের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কাজী রেজাউল করিমের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এঁর কথা কেন কিছু বলা হয়নি। আশ্চর্য!
রেজাউল করিমের সাথে গল্পে জমে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথাবার্তায় সাবলীল ছিলেন। বয়স তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর এখনো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই বৎসর ত্রিপুরায় নজরুলের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। স্মরণিকার জন্য আয়োজকরা পি কে ডি’কে লেখা দিতে বলেছিলেন। ওর লেখা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল প্রায়।
রেজাউল করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পি কে ডি জানালেন আজকে চুরুলিয়ায় এসে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সে ভাবছে তাঁকে আবার নতুন করে লিখতে হবে নজরুলকে নিয়ে। রেজাউল সাহেব জানালেন, আগরতলা থেকে তাঁকেও লিখতে বলা হয়েছে। সুস্থ থাকলে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ঐ অনুষ্ঠানে। তাঁর নিজের পরিবারের কথা জানালেন। নজরুলের নাতি নাতনিদের কথা বললেন। বলা বাহুল্য সেগুলো খুব প্রীতিকর কিছু নয়। তাঁর নিজের কষ্টের কথা জানালেন। সুবর্ণ কাজী, রেজাউল করিমের তিন পুত্রের একজন, যার মধ্যে তিনি কিছু সম্ভাবনা দেখেছিলেন সংগীতে , তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন হলেন সোনালী কাজী। বাকি এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের কেউই নজরুলের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সংসারের নিয়মই মনে হয় এমন। একজন আয় (সেটি যে কোনোকিছুই হতে পারে) করেন। পরের প্রজন্ম সেটি এনক্যাশ করে চলেন (তবে এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না কেননা কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ নিজগুণে গুণান্বিত ছিলেন)। আর তৃতীয় প্রজন্ম দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এই ফর্মুলা পুরোপুরি কাজে না লাগলেও নজরুলের আদর্শ থেকে এরা অনেক দূরে। আপাদমস্তক মার্ক্সিস্ট কাজী রেজাউল করিমের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।
এবারে রেজাউল সাহেব আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পাকা একতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ওপর পুরনো বাড়ির অনুকরণে খড় দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হলো। যে দুজন আমাদের প্রথমেই তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন তারাই রেজাউল সাহেবের দেখাশোনা করেন। পরিবারটি, অন্তত রেজাউল সাহেব, তাঁর চাচার মতো অসাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলেন। আমি বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাইলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর এবং বাসনপত্র দেখে অবাক হলাম। কেননা ছেলেরা এল্যুমিনিয়ামের ডেকচি কড়াই এমন পরিষ্কার রাখতে পারার কথা নয়। জানালেন রান্নার জন্য অন্য মহিলা আছে। আর তাঁর স্ত্রী যে ঘরে রাঁধতেন, সে ঘরটিও অবহেলায়, অযত্নে পড়ে নেই।
হঠাৎ রেজাউল করিম সাহেব আমাদের এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানতে চাইলেন এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পর আমাদের দেশে কীভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়? উত্তর দেবার বিশেষ কিছু ছিল না। অথবা বলা ভালো সংক্ষেপে বলার মতো নয় বিষয়টি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি তাঁর সহচরদের বললেন, আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সব বলতে নজরুল একাডেমি, লাইব্রেরি, নজরুল যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ভগ্নাবশেষ, পারিবারিক গোরস্থান ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিতে। তিনি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। ও হ্যাঁ, নজরুল একাডেমি-যেটি রেজাউল করিমের বড়ো ভাই প্রয়াত মোফাজ্জল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন।
কেননা এটি চালিয়ে নেয়ার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর সন্তানদের এবং নজরুলের নাতি নাতনিদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নেই। আমার মনে হয়েছিল কাজী রেজাউল করিম সাহেব স্বস্তিতে আছেন এই ভেবে যে নজরুল যথার্থভাবে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একটি ব্যাপার অনেকক্ষণ থেকে আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল নজরুলের বাড়ির সীমানা, একাডেমি, বিশাল লাইব্রেরি (যেখানে সতের হাজার বই রয়েছে, এটা পরে হয়েছে), কবরস্থান ইত্যাদি দেখে ভাবছিলাম কেন নজরুলকে বালক বয়েসে বাবাকে হারানোর পরে সংসার প্রতিপালনের জন্য রোজগার করতে যেতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন: কবিতীর্থে একদিন
নয় বছর বয়েসে মক্তব শেষ করার পর ঐ মক্তবে ছোটো শিশুদের তিনি পড়াতেন। মসজিদে আযান দিতেন। যোগ দিলেন লেটো দলে। এটি অবশ্য একেবারে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল না আমার দৃষ্টিতে। কেননা ঐ সময়ে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা স্ফুরিত হয়। নজরুল নিজেই সংস্কৃত এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেন। স্কুলে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। শিক্ষকরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর থেকে ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজায় নজরুল যুদ্ধ করতে চলে যান। আর স্কুলে ফিরে আসেননি।
আমার মনে হয় প্রকৃতিগত ভাবে নজরুল ছিলেন অতি চঞ্চল। ধরাবাঁধা জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না। সৃষ্টির নেশা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত। সংসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর পরে (প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের মাস কয়েক পরে মারা যান) তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বুলবুল কচিকন্ঠে অপূর্ব সুন্দর গাইতেন। নজরুলের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন স্বয়ং ঈশ্বর।১৯৩০ সালের মে মাসে বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। বারো বছর পরে ১৯৪২ সাল হতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। লেখালেখি করার ক্ষমতা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল ! বুলবুল মারা যাওয়ার পর কবি ছেলের স্মৃতিতে লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি …’!
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের নজরুল ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন। কবি বুঝতে পারেননি তিনিও ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।
কবি তাঁর ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছিলেন-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”
চিরকালের অসাম্প্রদায়িক নজরুল, যিনি সবসময় লড়াই করেছিলেন মানব ধর্মের জন্য; তিনি জানলেন না তাঁর দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়ের লোক। এই বিভাজন নজরুল মেনে নিতে পারতেন না জেনেই বিধাতা হয়তো বা তাঁকে বহু আগে থেকেই বাকশক্তি রহিত করে রেখেছিলেন। কে জানে!
নজরুলের এই কথাগুলো আজকের বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, সেটি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক, যাঁর এক ডাকে মুক্তিকামী বাঙালি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। তবে এই দেশের মাটিতে মীরজাফরদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষাধিক মা-বোনের নৃশংস অত্যাচার নির্যাতন ঘটিয়েছিল এই দেশের মীরজাফররা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। আর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশের এই অপশক্তিরা ঝাড়েবংশে বেড়ে চলেছে। একজন নজরুলের আবির্ভাব কী তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নকে, লড়াইকে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে? (সমাপ্ত)
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক