দুঃখ
নিখাদ দুঃখ পেলে, উপমায় কোনো রঙ থাকে না পৃথিবীর
যদিও কেউ কেউ মনে নিয়ে আসে অস্তগামী কোনো সূর্যের কথা, কিংবা পাতা ঝরা গাছের শরীর, বা এমন অন্য কতকিছুই, সবিশেষ সিদ্ধান্তে একটা মানুষ শঙ্খচূড়ের মতো বিষ ঢেলে করে গ্যাছে নীল, অথচ নীলকান্ত মনির পরশ মনে মনে আজন্মকাল লালিত রাখে সেও
নিখাদ দুঃখ পেলে, আমি জলকে চিনিতে পারি আমার জাতক, যার কোনো রঙ নেই, আছে শুধু অসংখ্য পায়ের চলন, কেবল সে-ই পেরেছে সব ছেড়ে সেখানে যেতে, যেখানে যাবার পথ তুমি আমি কেউই জানি না
দেশ
বিদূরে ডুবেছে চিরদিন, মৌরির সজলা মাঠের প্রিয় ধানের সিথান, বাথানের বিকালেরা সন্ধ্যায় কোনোদিনই ফিরে আসে নাই; তস্কর আর কত বিদূষকের জমিনে আমি নবান্নে তোমাকে খুঁজি, একটু বিদল পেলে হড়িয়াল পাখিরা যেমন মেলে দেয় পাখা, শ্যাওলার উঠানে যেমন একটা ডালিম আর তার উজ্জ্বল ফুলগুলো শিরশিরানির, ভাঙা গেরস্থালিতে খুব লাগায় প্রলেপ
আমাকে যদিও তসিলদারের সব মুখস্থ কথার এই বেসাতির দেশ কভু ছাড়ে নাই এক ইঞ্চি পথ,
তবু একটু সুবাস আর কদমের কলোরোল পেলেই ভাবি মায়াকাননের পাশে এক সরোবরে বসতি আমার, রঙিন মাছেরা ফুলকি তুলছে, জলে হিজল বাতাস, পারিজাত থেকে গেয়ে উঠছে পিউ পিউ পাখিটার বোল, বোবাধরা ছেড়ে গ্যাছে, আমাদের কথা ন্যাপথলিনের কোনো মাদলের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে সব ইচ্ছার বনভূমি জুড়ে
যদিও ইচ্ছার মামড়িতে অনন্তকাল এক বিচ্ছিরি শুকনো কাদার মতো সিল, যেন ঠেস মেরে আছে পুকুর পাড়ের বাঁকা সুপাড়ি গাছের এক কুঁজো শরীরের, ঘুরেফিরে আসছে এক পুনঃপৌনিক ভাদ্র মাস, বায়োস্কোপের কুঠুরিতে চোখ রেখে প্রতিটা দিন দেখছে আমাকে; আর বিদূরে আমার চিরদিনই ডুবে গ্যাছে মৌরির খেত
অবলম্বন
কারো কারো পৃথিবীতে কোনো পুষ্প নেই, দূর মাঠে দেখা নিঃশব্দ্য সাদা বৃষ্টির মতো, বিশেষ কোনো রঙ হয় না, কেবল একটা ধূসরতা ছাড়া
শীত কালের অপেক্ষায় থাকা তাদের জীবন, বিগত বর্ষাতেই মুছে যায়, তবু থাকে প্রচ্ছায়া, অমৃতের ধারণার মতো, এবং সেটাও যেন কোনো একলা ফলটি, আজন্ম যাকে পেতে চেয়েছে কেউ, জানা নেই কেন; মুখ্যত এর কোনো জবাবও নেই, যেন অনুত্তর প্রশ্নের মতোই এক প্রতিধ্বনি, ফিরে এসেছে বারবার পরিযায়ী উড়ন্ত হাঁসের মতো
কারো কারো পৃথিবী এমন একটা জলাশয়ের মতো, সব থেকেও যার কিছুই থাকে না, থাকে না সামান্য কোনো পরিতাপ, শূন্যতার মতো কোনো অবলম্বন
সকাল
থুম ধরা সকাল ঘুম ভাঙা নুড়িটা কোনো, যেন জামরুল; নিখুঁত সৌষ্ঠব আছে তাঁর মোহের মতন, যেন কোনো মহেঞ্জোদারো
কোটরাশ্রিত উড্ডীন যেমন বুঝে না বিন্দুর থেকে চিরদিন রেখাদের অধিগমনে সমস্ত হয়েছে যে আকাশ, তা একটা নিখুঁত শূন্যতার বৃত্ত, চিরকাল আয়তকার ভেবে তুমিও বিস্তারিত হয়েছো তাতে অমলিন বেলুনের মতো; বুকে মেঘ মিলিয়েছে আকরিক জলদের কণা ও কালি, তবু টু শব্দটা হয়নি কোনো, যেন সে এক অধীর শ্রাবণ, সেঁতারের ধ্রুপদী ঘোড়া, পুচ্ছ নাড়িয়ে দাপড়ে ছুটছে ম্রিয়কালে সজল তুফান
প্রতিটা সকালে আমি এমন নুড়ির মতো দেখি চকচক;
ক্ষয়িত রতির ক্ষীণ কূটাভাস, ছিটকে এসেছে দ্বারে উজ্জ্বল পালের শাবক, যার চোখের স্ফটিকে সেই কাঙ্ক্ষিত মনিটা তারার, তাকে আঁকড়ে হৃদয়ে ধরে সবটা বেলাকে খুব পাড়ি দেয়া যায়
স্পর্শের কড়িকাঠ
ভাড়া করা বিলাপের হৃদয় নিয়ে আমূল বিবর্তনের একটা ইন্টারফেসে কাতরতা উপভোগের এই পৃথিবীতে, তুমি যেন আগের চেয়ে আরো বেশি নন্দন চোখে মুখে হাজির রাখো, যেন আরো বেশি মানবিক বুলবুলিটা, তুলতুল করছো সজল, বৃষ্টি থামার পরে অতৃপ্ত মেঘের নিচে গাইছো ফাপা জংলি ফলের ঝোপে মরমের গান; বেভুলা প্রেমিক আমি মনে রাখি নাই, কখনোই, কোনোখানেরই কোনো একটা গুপ্ত হত্যার খবর
স্নায়ুতে আমার নেই তেমন আষাঢ়, উল্টানো কাছিম এক পড়ে আছি আকাশের দিকে, বুক ইটের ভাটার মতো, লোকালয় ভুলে বহুদূরে ছাড়ছি ধোঁয়া; বিনুনিতে গেঁথে নিয়ে আমার নদীটা, চোখের সামনে এসে মেলছো নাড়ান, যেন এক নিথর আয়নাটায় খুঁটে নিচ্ছো মুখের আদল, কারণ আর কিছুই না, জানো তুমি সবই
পোষা প্রাণীদের শিং মূলত স্পর্শের কড়িকাঠ, পাহার খোঁড়ে না
আবছায়া ডানার পাখি
বাতাসার মতো এক নদীমৌনতায় ভেবেছি দু’পাশটা চিরদিন ঢালুই থাকে জীবনের, যার সামান্য দূরেই থাকে সুন্দর; সন্ধ্যা বাছুরের খিল খিল, যেন ফিরে যাচ্ছে মা-র সাথে ধুলা উড়িয়ে
আরো দুটো অর্থের পাড়, যেন ভীষণ অনর্থে বেঁচে আছে দৃষ্টির মতো, চোখহীন, জোৎস্নায় অন্যের রূপের ভিতর যেন আবছায়া ডানার পাখি, ছায়া নেই যার
বিধৌত নিকশ গাছের বুড়া ডাল আমাদের মন, যার চামড়া স্বভাবতই ভুলে যায় সব শিরা উত্তাপ, যার ভোর ও দুপুর নিক্তিতে থেকে যায় আধুলির মতো, ময়লা ঢেকে ফেলে পুনর্জীবনের সব সাধ, তবু কোনো আনমনা ফুড়ুতের পাখি এসে বুক জুড়ে ছড়িয়ে বসলে মনে হয়, অর্থের বাইরেই সব সুন্দর, যেন কোনো শিস দেয়া মাছের চিহ্নের অপেক্ষায় থাকাই জীবন, এঁদো কোনো ডোবাটির জলে
সত্য
পেকে ওঠা ফলের দৃশ্যের অদূরেই থাকে
অপারগ চোখের রোদন, তাই কেবলই মধুমাস বলে জানা এক পক্বকাল, চিরদিনই একটা নীল রঙকে অবজ্ঞায় রাখে
এভাবেই পৃথিবী চিরদিন বর্ণবাদ ছড়িয়ে রেখেছে সব শাখা প্রশাখায়, এখানে ওখানে
যুত ও সহিতে তুমি তাকে বানিয়েছো কখনো মনিহার, কখনো চাবুকের হাতা
পৃথিবী এমনই এক উড়ন্ত বেলুন, যখন উড়তে থাকে, বিহবলতার এক উর্দ্ধমুখী সুখ চেয়ে দেখে তাকে, কেবল পতনেই পায় তারে মাটি, তখন সত্য খুলে রাখে তাঁর অন্য অভিমুখ
যেমন জলো দিনের নদীতে জল দেখে না কেউ, শুধু দ্যাখে কতটা দূরের দিকে সরে গ্যাছে তীর