ভারতে সত্তরোর্ধ্বদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা : বাংলাদেশ কি ভাবছে?

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2024-07-02 20:47:57

সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। গত বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এই ঘোষণা দেন। আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের অধীনে বিনামূল্যে এই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে বলে জানান দেশটির রাষ্ট্রপতি।

পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মুর্মু আরও বলেন, আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা প্রকল্পের অধীনে ৫৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে দেশে ২৫০০০টি জন ঔষুধী কেন্দ্র খোলার কাজও দ্রুত গতিতে চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাবলিক অর্থায়িত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পটির অধীনে দরিদ্র পরিবারগুলো ৫ লাখ পর্যন্ত রুপি বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য দেয়া হচ্ছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্যও খবরটি বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আমরা জানি যে, কোন দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের একটি অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে সেই দেশের জনগণের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্ট কিছু রোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে, মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। কিন্তু সার্বজনীন স্বাস্থসেবা নিশ্চিতে বাংলাদেশ এখনো মাইলকফলক স্পর্শ করতে পারেনি, এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ৬৯ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় নিজেরাই নির্বাহ করেন। গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক সময় তাদের শেষ সহায়-সম্বল ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু অনেক সময়- সব বেঁচেও তারা তাদের স্বজনদের সুস্থ করে তুলতে পারেন না। উল্টো ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে শহরের অলি-গলি বা বস্তিতে ঠাই নেন। খোঁজ নিলে এমন দৃষ্টান্ত অজস্র দেয়া যাবে। গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর তথ্য বলছে, নিতান্তই অপারগ হয়ে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ধারদেনা, ফসলি জমি বা ভিটেমাটি বিক্রি বা বন্ধক রাখেন শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ। এই সংখ্যাকে উদ্বেগজনক বললেও অত্যুক্তি হবে।

প্রায় দেড়শ’ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে স্বাস্থ্যসেবায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যয় ৬৩ শতাংশ। সেক্ষেত্রে ভারতে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশের জন্যও এটি অনুসরণযোগ্য বার্তা হতে পারে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা নেওয়া নাগরিকদের একটি বড় অংশই সত্তরোর্ধ্ব। এই সংখ্যার একটি বড় অংশ আবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সেই বিচারে প্রবীণদের চিকিৎসাসেবায় আনুকূল্য প্রদান যেমন রাষ্ট্রের মানবিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাবে তেমনি সার্বজননীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের যে লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের তা অর্জনেও অগ্রগতি আসবে।

সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা প্রদানে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার রয়েছে তার জনগণের কাছে তা অর্জনে শাসকদের আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আলোচিত স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার বিল নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সে বিষয়ে অনড় ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অবশ্য প্রেসিডেন্ট বারাব ওবামার স্বাস্থ্যসংস্কার প্রস্তাবের সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে বিদ্রুপের কিছু নেই। এ প্রস্তাবনায় মমতা আছে।’

আমরা লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক দশক বা বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে অকাঠামো বা যোগাযোগ উন্নয়নে যে বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়, অপরদিকে স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষার মত খাতগুলো সেখানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পায়। তবে বৈশ্বিক উন্নয়ন মানদণ্ডের নিরিখে স্বাস্থ্যখাতকে উপেক্ষার সুযোগ নেই, এ কথা জোর দিয়েই বলা যাবে।

জনগণের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির যে অধিকার তা স্বীকার করে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্য সকল উন্নয়ন প্রাধিকারের সঙ্গে সমান গুরুত্বে স্বাস্থ্যখাতকে বিবেচনার কোন বিকল্প নেই। সরকারকে ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ৭০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বিনামূল্যে সব ধরণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ভারতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর