দামেস্ক-নেপিদো: আসাদের পথেই কি মিন অং হ্লাইং?

, যুক্তিতর্ক

| 2024-12-13 12:45:57

সামরিক জান্তার অধীনে বসবাস করে মিয়ানমারের জনগণ তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সুসংবাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন অপরাধী সামরিক শাসন ব্যবস্থা ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়তে যাচ্ছে-এমন পরিবর্তনের জন্য জনগণ মুখিয়ে আছে। গত রোববার এমনই কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনাকেই অনুভব করতে পেরেছেন তারা।

সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অত্যাশ্চর্য বিজয়ে বাশার আল-আসাদের কয়েক দশকের শাসনের অবসানে বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনীর রাজধানী দখল এবং রাষ্ট্রপতিকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা, দামেস্কের রাস্তায় সিরিয়ানদের স্বাধীনতা উদযাপন করার খবর এবং ছবি মিয়ানমারের জনগণ ব্যাপকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। মিয়ানমারে বিরোধী বাহিনী এবং বেসামরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন বিমান হামলা চালানোর নির্দেশদাতা জেনারেলদের প্রতি এটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। যা কোন ডিজাইনকৃত ভুল প্রচারণা ছিল না, জনগণের স্বতোস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এ প্রচারণায়।

মিয়ানমারেও কি সিরিয়ার মতো একই রকম পরিস্থিতি হতে পারে? এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় দেখতে পাচ্ছি—আসাদ সরকারের মত পতন মিয়ানমারে ঘটতে পারে কিনা তা নিয়ে সীমাহীন চর্চা চলছে। মিন অং হ্লাইং যদি একই পরিণতির মুখোমুখি হয়, তবে রাশিয়া বা চীন কি তাকে এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে? যদিও এই মুহুর্তে এটি কিছুটা দূরবর্তী বিষয়, তবে মিয়ানমারের বিপ্লবের অনেক কট্টর সমর্থক এমন একটি ফলাফলেরই আশা করছেন।

সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা, এমনকি দেশটি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে; তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের মানুষ সাগ্রহে দামেস্কে খুনি শাসনের পতনের খবর শেয়ার করেছেন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রগুলি আসাদের পরাজয়ের বা রাশিয়ায় তার ফ্লাইটের কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি, যখন আসাদ সরকারও অব্যাহতভাবে মিয়ানমার জান্তার শক্তিশালী মিত্র ছিল।

আকস্মিক পতন প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসনের জন্যই দুঃস্বপ্নের, তবে এটি যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে এবং মিয়ানমারও এর ব্যতিক্রম নয়। সিরিয়ার জনগণকে এতে আনন্দিত হতে দেখে মিয়ানমারের জনগণও অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। মিয়ানমারের জনগণ এবং বিরোধী দলগুলো নিজেদের সেই দিনের স্বপ্ন দেখছেন, যেদিন নেপিদোতে মিন অং হ্লাইং সরকার একই পরিণতির মুখোমুখি হবে।

আসাদের মতো, মিন অং হ্লাইং গত চার বছরে তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অপরাধ করেছে এবং জনগণ সেই নৃশংসতা জনগণ সহজে ভুলবে না। আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের জনগণও দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনীর রাখাইন এবং চিন রাজ্যে আরও কৌশলগত শহর দখলের খবর জেনেছে। আরাকান আর্মির কাছে রাখাইনে মংডুর পতন এবং জান্তা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে বন্দী হতে দেখেছে। এখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত আরাকান আর্মির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই বিজয়ের আবহেই চীন প্রদেশে প্রতিরোধ বাহিনী রাজ্যের রাজধানী হাখা এবং থানলাংয়ের মধ্যবর্তী কৌশলগত সমভূমিতে শেষ নিরাপত্তা ফাঁড়িটি দখল করে নিয়েছে। দেশটির উত্তরে কাচিন রাজ্যে, চীনের চাপকে উপেক্ষা করে, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) ভামো এবং মানসি শহরে সরকারী চৌকিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতোই তবে কি মিন অং হ্লাইং একটি বিভ্রান্তিকর স্বপ্নের জগতে বাস করছেন? এমনকি তার সৈন্যরা যখন বিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলি সারা দেশে ক্রমাগত সঙ্কুচিতত হয়ে আসছে তবুও তিনি বিশ্বাস করেন যে মিয়ানমার ‘সোনার ভূমি’ ‘স্থিতিশীল’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’!

প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সাল থেকে তার শাসনকালে মিয়ানমারের বেশিরভাগ অংশ ছাই হয়ে গেছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা চরমে পৌছেছে। তার সেনাবাহিনী প্রতিরোধ শক্তির অভূতপূর্ব চাপ এবং এখন বিস্ফোরণের সম্মুখীন। কিন্তু মিন অং হ্লাইং এখনও বিশ্বাস করেন যে তিনি চীন এবং রাশিয়ার মতো তার প্রধান বিদেশী মিত্রদের সহায়তায় দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

কিন্তু সিরিয়ার বিদ্রোহীরা যখন দামেস্কের পথে ছিল তখন আসাদের মিত্র ইরান এবং রাশিয়ার কাছ থেকে কোনো সহায়তা আসছিল না, আসাদ এবং তার পরিবারকে তাদের জীবনের জন্য দৌঁড়াতে বাধ্য করেছিল, এই সত্যটি তার মনে রাখা ভাল।

এমন অবস্থাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান। আজ দেশব্যাপী প্রতিরোধ প্রচেষ্টাগুলো চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসক আসাদের মতো একই পরিণতির মুখোমুখি হবেন না এমন সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছে না। আজ নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসাদ সরকারের পতন ৬০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের মিয়ানমারের জনগণের জন্য আনন্দের উৎস এবং অবশ্যই নেপিদোর নেতৃত্বকে এটি নাড়া দেবেই।

মিয়ানমারের জনগণের কাছে ইতিহাসের সান্ত্বনাদায়ক স্মৃতি হিসাবে কাজ করছে যে সমস্ত স্বৈরশাসকেরই শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে, তাদের যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন। মিয়ানমারের মানুষ তাদের নিজ দেশে দমনমূলক শাসনের উত্থান-পতন দেখেছে। তারা কষ্ট পেয়েছিল এবং অবশেষে তারা তা কাটিয়ে উঠবেই। মিন অং হ্লাইং এর ক্ষমতায় আরোহণ ও তার বিরোধিতায় অটল প্রতিরোধ আন্দোলনে মিয়ানমারের জনগণ বর্তমানে আরেকটি বিশৃঙ্খল সময় সহ্য করছে। নিঃসন্দেহে যখন কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে
জনগণ পরবর্তী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাবেই। মিন অং হ্লাইং-এর জন্য এটি ভয়ের কারণ।

দ্য ইরাবতী’র সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে ভাষান্তার: আশরাফুল ইসলাম

এ সম্পর্কিত আরও খবর