সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত শ্যামনগর উপজেলার বংশিপুরের আজিজ মোড়ল। অনেকদিন ধরেই তার ছেলে জয়নাল ক্রনিক কিডনি রোগে (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ- সিকেডি) আক্রান্ত।
পরিবারে স্বচ্ছল অবস্থা না থাকায় ভালো প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালিসিস করাতে পারছেন না। তবে তারই জেলা শহর সাতক্ষীরায় অবস্থিত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতাল। সেখানে কিডনি ডায়ালিসিস করাবেন, তারও উপায় নেই। কারণ, সামেক হাসপাতালের ১৯টি ডায়ালিসিস মেশিনের মধ্যে ১৬টিই মেশিন বর্তমানে বিকল।
এ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন জয়নালের মতো অসহায় কিডনি রোগীরা।
জয়নাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার মা ভিক্ষা করে আমার ডায়ালিসিসের খরচ চালান। এখন যদি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা বন্ধ করে দেয়, তাহলে যেকোনো সময় আমার মৃত্যু হবে। কারণ, প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডায়ালিসিস করানোর সামর্থ্য আমাদের নেই।
শুধু জয়নাল নয়, তার মতো একজন জহুরুল কবীর। সাতক্ষীরা শহরের বাসিন্দা তিনি। পেশায় একজন সংবাদকর্মী। তার স্ত্রী অনেকদিন ধরেই সিকেডিতে আক্রান্ত। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় জমি বিক্রি করে তার চিকিৎসা করাচ্ছিলেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে তিনটি সেশনে ১২ ঘণ্টা করে ডায়ালিসিস করা প্রয়োজন। কিন্তু সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালের একাধিক মেশিন বিকল থাকায়, দুই সেশনে চার ঘণ্টা করে সপ্তাহে আট ঘণ্টা ডায়ালিসিস করানো হতো। কম খরচে এই হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়ে স্ত্রীকে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
কিন্তু গত মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে আসা ফোন কলে তিনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। এখন থেকে তার স্ত্রী সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার ডায়ালিসিস করার সুযোগ পাবেন। ১৯টির মধ্যে মাত্র তিনটি মেশিন এখন সচল রয়েছে। রোগীর চাপের কারণে সপ্তাহে একবারের বেশি ডায়ালিসিস সেবা পাওয়া যাবে না।
জহুরুল কবীর বলেন, ‘সপ্তাহে চার ঘণ্টা ডায়ালিসিস করালে অধিকাংশ রোগীই বাঁচবে না। খবরটি শুনে অনেক কেঁদেছি!’ স্ত্রীকে বাঁচাতে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯টি ডায়ালিসিস মেশিনের মধ্যে ১৬টি বিকল। একটি পুরোপুরি সক্রিয় থাকলেও দুটোর কাজ চলছে জোড়াতালি দিয়ে। ফলে নিয়মিত চিকিৎসা করা কিডনি রোগীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। এ অবস্থায় তিনটি সচল মেশিন দিয়ে সপ্তাহে একদিন রোগীদের ডায়ালিসিস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, অদক্ষ ব্যক্তি দিয়ে মেশিন পরিচালনা করায় হাসপাতালের ১৬টি ডায়ালিসিস মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি তিনটিও নষ্ট হওয়ার পথে।
কিডনি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা ছাড়াও আশপাশের জেলার রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। ইউনিটের চালু থাকা প্রতিটি যন্ত্র দিয়ে দিনে দুই থেকে তিনজন রোগীর ডায়ালিসিস করানো হতো। ইউনিটে গড়ে ৩৫-৪০ জন রোগীর প্রতিদিন নিয়মিত ডায়ালিসিস করানো হতো। পর্যায়ক্রমে ৬০-৭০ জন সিরিয়ালে থাকতেন। একজন রোগীর সপ্তাহে দুদিন করে ডায়ালিসিস করা হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ডায়ালিসিসের জন্য ২শ টাকা ফি নেওয়া হয়। এতে সাধারণ ও দরিদ্র রোগীরা কম খরচে সেবা পান। জেলার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকেও রোগী আসেন।
কয়েক মাস আগেও ১৯টি যন্ত্রের সবগুলো চালু ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে একটি একটি করে যন্ত্রগুলো নষ্ট হতে থাকে। ফলে চাপ বাড়তে থাকে বাকি যন্ত্রগুলোর ওপর। অকেজো মেশিনগুলো সময়মতো মেরামত না করায় বর্তমানে তিনটি চালু আছে। তা দিয়ে তালিকাভুক্ত শতাধিক কিডনি রোগীকে ডায়ালিসিস সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে গত মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০ মার্চ থেকে সপ্তাহে দুটির পরিবর্তে মাত্র একটি ডায়ালিসিস করানো হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন ঘোষণার পর বিপাকে পড়েছেন রোগীরা। বর্তমানে আতঙ্কে ভুগছেন তারা।
হাসপাতালের কিডনি ডায়ালিসিস ইউনিটের ইনচার্জ নমিতা রানী বলেন, ‘১৯টি মেশিনের মধ্যে একটি ভালো থাকলেও অপর দুটি মেশিনে জোড়াতালি দিয়ে রোগীদের ডায়ালিসিস চলছে। ফলে এখন থেকে সপ্তাহে দুই অথবা তিনবার ডায়ালিসিস দেওয়া সম্ভব হবে না।’
এ ব্যাপারে সামেক হাসপাতালের পরিচালক শীতল চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের মোট ডায়ালিসিস মেশিন ১৯টি। এর মধ্যে বর্তমানে তিনটি সচল আছে।
মেশিন নষ্ট হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, অদক্ষ ব্যক্তি দিয়ে মেশিন পরিচালনা করায় মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নষ্ট মেশিনগুলো মেরামত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। মেরামতের জন্য কয়েক দফায় টেকনিশিয়ান এসেছেন। কিন্তু খুচরা যন্ত্রাংশ না পাওয়া যাওয়ায় মেশিনগুলো ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না।
নষ্ট মেশিনগুলো দ্রুত মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।