‘সচেতন থাকলে মাঙ্কিপক্স নিরাময় সম্ভব’

  • বাকৃবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মো. বাহানুর রহমান

অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মো. বাহানুর রহমান

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জনস্বাস্থ্যে মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। তবে সচেতন থাকলে মাঙ্কিপক্স রোগটি নিরাময় সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ও অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মো. বাহানুর রহমান। এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ, সংক্রমণ, প্রতিরোধে করণীয় এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেনও তিনি।

ড. মো. বাহানুর রহমান বলেন, রোগটি মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয় যা পক্সভিরিডি পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাস গোত্রের একটি ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস এবং ক্লেড ১ ও ক্লেড ২ এই দুটি ধরণ রয়েছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে যা ডিম্বাকার ইটের আকৃতি প্রদর্শন করে।

বিজ্ঞাপন

এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের লক্ষণগুলো সম্পর্কে ড. বাহানুর বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ফুসকুড়ি, জ্বর, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, পিঠে ব্যথা, দুর্বলতা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলো দেখা যায়। ভাইরাসের আক্রমণের লক্ষণ সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয় এবং প্রায় দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়। ফুসকুড়ি একটি চ্যাপ্টা ঘা হিসাবে শুরু হয়ে ফোস্কায় পরিণত হয় এবং চুলকানি বা ব্যথা হতে পারে। হাতের তালু, পায়ের তলা, মুখ, গলা, কুঁচকি, যৌনাঙ্গ ও এর আশপাশে এবং মলদ্বারসহ শরীরের যে কোনও জায়গায় ক্ষত হতে পারে। তবে ফুসকুড়ি সেরে যাওয়ার সাথে সাথে ক্ষতস্থানও শুকিয়ে যায়।

এমপক্স সংক্রমণ সম্পর্কে ড. বাহানুর বার্তা২৪.কমকে বলেন, এ রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্কসহ দুর্বল রোগপ্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরা। এমপক্স ভাইরাস ত্বকের ক্ষত, থুথু, লালা, হাঁচি, কাশি, নাকের পানি ও যৌনাঙ্গের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির জামাকাপড়, কম্বল, তোয়ালে, খাবারের পাত্র ব্যবহার করলেও ভাইরাসটি সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সংক্রমণ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন ছোট প্রাণি যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ সংক্রমিত হলে তাদের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে পশুতে ও এমনকি মানুষেও ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে।

এমপক্স ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ড. মো. বাহানুর রহমান। তিনি বলেন, এমপক্সের বিস্তার রোধ করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে বাড়িতে বা হাসপাতালে আইসোলেশন এর ব্যবস্থা করা উচিত। আক্রান্ত প্রাণি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোয়া। বিশেষ করে এমপক্স আক্রান্ত ক্ষতস্থান স্পর্শ করার আগে এবং পরে। ক্ষত ঢেকে রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা, আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক শুষ্ক রাখা উচিত। মুখের মধ্যে ঘা হলে নোনা জল দিয়ে ধোয়া। শরীরের ঘা হলে সিটজ বাথ, বেকিং সোডা বা ইপসম সল্ট দিয়ে উষ্ণ স্নান করা। যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার করা। ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খেতে হবে।

মাঙ্কিপক্স রোগ নির্ণয় পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, মাঙ্কিপক্স রোগ নির্ণয়ে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলো তেমন কার্যকর নয়। গবেষণাগারে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) দ্বারা এমপক্সের ভাইরাল ডিএনএ নমুনা থেকে সনাক্ত করা হয়। নমুনা হিসেবে সরাসরি ক্ষতস্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ক্ষত না থাকলে গলা ও মলদ্বার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।

এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের আসলে চার দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত তবে কোনো লক্ষণ দেখা না দিলে ১৪ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দেয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ড. বাহানুর রহমান।

এ পর্যায়ে রোগটির চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, বেশ কিছু অ্যান্টিভাইরাল যেমন গুটি বসন্তের চিকিৎসায় ব্যবহৃত টেকোভিরিম্যাট এমপক্সের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে। আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কানাডা জুড়ে 'এমভিএ-বিএন' নামে এমপক্সের কেবল একটি ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়েছে। 'এমভিএ-বিএন'ভ্যাকসিনটি সাধারণত ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি মাত্রায় দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনে আরও ৩টি ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলো হলো জাপানের এলসি-১৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার এসিএএম-২০০০ এবং রাশিয়ার অর্থোপক্সভ্যাক। এগুলোর সবই মূলত প্রস্তুত করা হয়েছিল গুটিবসন্ত ও অর্থোপক্স গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে। এককভাবে এমপক্সের ভ্যাকসিন এখনও গবেষণাধীন। এছাড়া ‘বিএনটি-১৬৬’ বিশেষভাবে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয় যা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মতো একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন।

বাংলাদেশে এমপক্সের ঝুঁকি সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, ২০২২ সালে এমপক্সের প্রাদুর্ভাব খুব দ্রুতই ইউরোপ ও আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে যৌন কার্যকালাপকে উল্লেখ করেন। এছাড়া ওই বছর সুদান প্রজাতন্ত্রের শরণার্থী শিবিরগুলিতেও এমপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি শনাক্ত হয়নি। তবে এমপক্স সংক্রমিত দেশগুলো থেকে আগত প্রবাসী ও ভ্রমনকারীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর মতো মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব ব্যাপক শঙ্কা সৃষ্টি করেছে, তবে এটি প্রতিরোধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন থাকলে এই রোগটির নিরাময় সম্ভব।