মেডিটেশন হলো মনের ব্যায়াম। নীরবে বসে সুনির্দিষ্ট অনুশীলন বাড়ায় মনোযোগ, সচেতনতা ও সৃজনশীলতা। মনের স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। প্রশান্তি ও সুখানুভূতি বাড়ানোর পাশাপাশি ঘটায় অন্তর্জাগৃতি।
প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস নিউরোসায়েন্স গবেষণায় বর্তমান বিশ্বে নেতৃস্থানীয় গবেষকদের একজন। ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব সংকটময় একটা সময়ে মেডিটেশন ও ইয়োগা চর্চা শুরু করেছিলেন। অতঃপর সফলভাবে ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত তার 'দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন বুক : অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন' বইতে তিনি বলেন, 'প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় আমি ঘুম থেকে উঠি। এরপর ইয়োগা করি এবং একঘণ্টা মেডিটেশন করি। এটি সুনিশ্চিতভাবেই স্ট্রেস কমায়। মেডিটেশন হতে পারে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার পরিপূরক।'
আরেক চিকিৎসক প্রফেসর ডা. ডেভিড আর স্যান্ডওয়েস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহ্ হেলথের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ থেকে তিনি মাইন্ডফুলনেস নিয়ে নানাবিধ কার্যক্রমে জড়িত।
তিনি বলেন, 'একবার মৃত্যুপথযাত্রী এক শিশুকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছি। বুঝতে পারলাম, বছর পেরোনোর আগেই হয়তো শিশুটির মা-কে তার সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটা জানাতে হবে। উপলব্ধি করলাম, এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে আমি এখনো প্রস্তুত নই। মেডিকেল স্কুলগুলো আমাদের চিকিৎসক হিসেবে দক্ষ করে তুলেছে। কিন্তু শেখায়নি কীভাবে আমরা হারানোর বেদনা, ভুলভ্রান্তির পরাজয়ের মুহূর্তগুলোকে মোকাবিলা করব। ফলে শোক আর অনিশ্চয়তা কখনো কখনো সুনামির মতো ভর করে। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা হাসপাতালে কাজের পর স্থির থাকাও কঠিন। তাই মানসিক স্থিরতার জন্যে চিকিৎসকদের মেডিটেশন চর্চা প্রয়োজন।'
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফিজিশিয়ানস্ ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালায়। এর তথ্য মতে, প্রতি ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৬ জন বার্ন-আউট বা ক্ষোভে-অবসাদে ফেটে পড়ার মতো অনুভূতিতে ভোগেন প্রায়শই। ৭৫ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী ভোগেন তীব্র বিষণ্ণতায়। ৫৫ শতাংশ বলছেন, তারা হতাশ এবং জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পান না।
উল্লেখযোগ্য একটি জরিপ বাংলাদেশেও হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত দ্য অফিসিয়াল জার্নাল অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ ঢাকার একটি প্রবন্ধে বলা হয়, এদেশের ৪০.৮ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং-এর ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর রিপোর্ট অনুসারে, ডিপ্রেশনের কার্যকরী সমাধান হলো মেডিটেশন। ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি বেশি মনোযোগী।
২০২০ সালে চীনে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা হয়। এতে ১০৬ জন চিকিৎসককে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে আট সপ্তাহব্যাপী মেডিটেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপ তাদের চিরাচরিত রুটিনেই জীবনযাপন করেন। দেখা গেছে, ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। রোগীর সাথে কথোপকথনে তারা আগের চেয়ে মনোযোগী।
যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন এন্ড ডেন্টিস্ট্রির প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ, লেখক ও কমিউনিকেশন এন্ড মাইন্ডফুল প্র্যাকটিস ইন মেডিসিনের শিক্ষক রোনাল্ড এম. এপস্টেইন বলেন, 'চিকিৎসক এবং চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে যারা মেডিটেশন করেন, তারা রোগীদের সাথে কথা বলায় অধিক মনোযোগী। পেশাগত ত্রুটি শুধরে নিতে আন্তরিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তৎপর। পেশাগত চাপ তাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।'
বিশ্ব জুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করেন। শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক অর্থাৎ সুস্থ থাকতে মেডিটেশন বা ধ্যানের কার্যকারিতা এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত।
পুরো বিশ্বের মত আমাদের দেশেও দিনদিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি যোগ-মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন প্রতিবছর বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে প্রাণায়াম বা দমচর্চা, প্রত্যয়ন পাঠ ও মেডিটেশন চর্চার আয়োজন করে থাকে। গত ২ বছর ধরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি।
সময় এসেছে নিজের দিকে তাকানোর- আপনি কি রোগী হওয়ার পর মেডিটেশন শুরু করতে চান? নাকি এখনই? আজই সিদ্ধান্ত নিন।