৭০ বছরের ইতিহাসে এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটেনি। সারা বিশ্বের এমন প্রবলতর রোগাক্রান্ত পরিস্থিতিতে আর কখনো আসেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবার ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো এমন হলো। পুরো পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাসের আতঙ্কজনক মহামারির মধ্যে এসেছে ৭ এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
২০২০ সালে ঠিক এই দিনটিতে বা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সমগ্র বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১,২৮৯,৩৮০ জন আর মৃত্যের সংখ্যা ৭০,৪৮২ জন। বিশ্বের প্রায়-সকল দেশেই কমবেশি আকারে হলেও করোনার অস্তিত্ব ও তাণ্ডব বিরাজমান।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ বিভাগ প্রদত্ত এই তথ্য-পরিসংখ্যানের আশাবাদী দিক হলো, ২৭০,২৪৯ জন মানুষ প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়েছেন। যে চীনে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, সেখানে তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। চীন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে।
একই আশাবাদ শোনা যাচ্ছে, করোনায় আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ পাঁচটি দেশের অন্যতম ইতালি, স্পেন ও জার্মানি থেকেও। সেখানে করোনায় মৃত্যুর হার কমেছে। আক্রান্ত মানুষের সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার হার বেড়েছে এবং কার্যকরী প্রতিষেধক ঔষধ আবিস্কৃত না হওয়ার পরেও সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের মাধ্যমে রোগটির কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণের ধারা ঠেকানোর সক্ষমতা দেখা গেছে।
করোনার কারণে এমনই ঘোরতর স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের পৃথিবীতে চলছে ঘরবন্দী মানুষের সঙ্গরোধের প্রহর। সঙ্কুল পৃথিবী এখন আতঙ্ক ও ভীতিতে নিঃস্তব্ধতার মৃত্যুপুরী। জীবন্ত নগর, জনপদগুলো মৃত্যুর হাতছানিতে জনমানবহীন ভূতুরে।
এমনই চ্যালেঞ্জিং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আশাবাদের প্রত্যয় জাগিয়েছে, যেমন প্রত্যয় ও প্রতীতি জাগ্রত হয় প্রতি বছরেই, দিবসটির মূল প্রতিপাদ্যে। চলতি বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূলকথা হলো 'সাপোর্ট নার্সেস অ্যান্ড মিডওয়াইফস'। করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে যে সেবিকা ও ধাত্রীগণ লড়ছেন, তাদের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করা হলো এই ঘোষণার মাধ্যমে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, করোনার আক্রমণের প্রাথমিক আঘাত সামলাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বহু স্বাস্থ্য পেশাজীবি। যে উহান থেকে করোনার উৎপত্তি, সেখানে প্রথম ভাইরাসটি শনাক্তকারী চিকিৎসকের মতো করোনায় শত শত ডাক্তার, নার্স, হেলথ টেকনিশিয়ান প্রাণ হারান। যদিও করোনার কবল থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য চাকরি ছেড়ে কর্মস্থল ফেলে ভয়ে পালিয়েও যান হাজার হাজার স্বার্থপর ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী।
পৃথিবী পলাতকদের নয়, সাহসী ও বীরদের মনে রাখে, এই চিরাচরিত সত্যের আলোকে করোনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে এ বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে স্বাস্থ্যসেবায় সামনের কাতারে থেকে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধরত স্বাস্থ্য-সৈনিকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদেরও নতুন করে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও (হু), যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের উদ্যোক্তা, তারা এ বছরের মূল প্রতিপাদ্যের সমর্থনে নিজস্ব ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সমন্বিত ও জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সেবিকা ও ধাত্রীদের প্রতি আরও সাহায্য বাড়াতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন করতে হবে।
কারণ, মহামারী, ছোঁয়াচে রোগ, আপদ ইত্যাদি প্রতিরোধ, নারীস্বাস্থ্য নিশ্চিত এবং ব্যক্তি ও সমাজকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুরক্ষা দিতে সরাসরি সেবা ও প্রণোদনা জাগান এরাই। করোনার বিরুদ্ধেও চিকিৎসা আর সেবা নিয়ে সামনে কাতরে থেকে লড়ছেন তারা। এ বছর আন্তর্জাতিক সেবিকা ও ধাত্রী বছরের কথা মনে রেখে ২০২০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল ফোকাসে আনা হয়েছে তাদেরকে।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরম রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী অভিজ্ঞতার ফলে বিশ্বের প্রায়-সকল রাষ্ট্রই একমত হয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘ গঠন করে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৬ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রূপরেখা তৈরির জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিশনের মতামতের আলোকে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল গঠন করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বিশ্বের মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং জীবন রক্ষার শপথে পরিচালিত হতে থাকে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন। নির্ধারিত দিনে জেনেভায় সংস্থাটির প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৪৬টি সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। প্রতিনিধিদের আলোচনার ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের কথাটি উঠে আসে এবং সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে। ৭ এপ্রিল তারিখটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো, দিনটি সংস্থার জন্মদিনও।
প্রতিবছর স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে সংস্থাটি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যা বিশেষ করে সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়। ১৯৫০ সালের প্রথম স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নো ইওর হেলথ সার্ভিসেস’ অর্থাৎ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। এভাবে বছরের পর বছর ধরে ৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের।
১৯৫০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বার্তা নিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রসঙ্গে উচ্চারিত হয় জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নামটিও। উচ্চারিত হয় বিশ্বের জন্য একটি প্রয়োজনীয় প্রতিপাদ্য, যা বিশ্ববাসীর সমকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথকে সুগম করে।