রাষ্ট্রীয় খরচে পবিত্র হজ পালনের সুযোগ সীমিত করার সিদ্ধান্ত বছর না ঘুরতেই পাল্টে গেল। এ বছর সরকারি খরচে হজে যাচ্ছেন ৭১ জন। তবে সূত্রে জানা গেছে, নামের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। নতুন তালিকায় সাংবাদিক, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকারের আর্থিক সহায়তায় হজপালনে যাওয়া ব্যক্তিদের নামে ইতিমধ্যে আলাদা দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সচিব, বর্তমান বিচারপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। এতে সরকারের খরচ হবে প্রায় তিন কোটি টাকা।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পাওয়া সাপেক্ষে তারা আগামী ৬ জুন সৌদি আরব যাবেন। হজ শেষে তাদের দেশে ফেরার কথা আগামী ১০ জুলাই। সরকারি খরচে হজে যাওয়া ব্যক্তিরা বিমানের টিকিট বাবদ ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা জমা দেবেন। এর বাইরে প্রত্যেক হজযাত্রীকে নিজ দায়িত্বে কোরবানি (দমে শোকর)-এর খরচ বাবদ আটশত সৌদি রিয়াল পৃথকভাবে সঙ্গে নিতে হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফ্লাইট ভাড়ার বাইরে সব খরচ সরকার বহন করবে। এমনকি হজে যাওয়ার আগে সবাইকে খাবার বাবদ ৩৫ হাজার টাকা করে হজ অফিস থেকে নগদ প্রদান করা হবে। এভাবে একেকজনের পেছনে সরকারের খরচ হবে প্রায় চার লাখ টাকা।
প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছর রাষ্ট্রীয় খরচে যারা হজে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ২৩ জন। আরও রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. কুদ্দুস খান ও বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান। তালিকায় প্রবীণ রাজনীতিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মো. মঞ্জুরুল আহসান খানের নামও রয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, গাড়িচালক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন তালিকায়। তাদের মধ্যে চার দম্পতি রয়েছেন। রয়েছেন ভাই-বোনও।
এবার বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চার হাজার ৫৬২ জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮০ হাজার ৬৯৫ জনসহ মোট ৮৫ হাজার ২৫৭ জন হজ করতে যাবেন। ইতোমধ্যে হজযাত্রার ফ্লাইট শুরু হয়েছে এবং ১৭ হাজার ১৪১ জন হজযাত্রী সৌদি আরব গমন করেছেন।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। আর, বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
২০২৩ সালে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছিলো ছয় লাখ ৮৩ হাজার টাকা। বেসরকারি প্যাকেজে খরচের সর্বনিম্ন সীমা ছয় লাখ ৭২ হাজার টাকা স্থির করা হয়।
রাষ্ট্রীয় খরচে যারা হজে যাচ্ছেন
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন জামালপুরের মো. আ. করিম, মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. নুরুল ইসলাম, মো. আনোয়ারুল ইসলাম, নড়াইলের শেখ নওশের আলী, রাজবাড়ির মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, গাইবান্ধার মো. তাজুল ইসলাম সরকার, কুমিল্লার বাহার উদ্দিন রেজা (বীর প্রতীক) ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম, গোপালগঞ্জের মো. ফিরোজ ফকির, বরিশালের আল্লামা হারুন-অর-রশিদ, ঝালকাঠির তাজুল ইসলাম চৌধুরী, রংপুরের আনোয়ারা বেগম, মো. ফজলাল রহমান, ঝিনাইদহের মো. নুরুল ইসলাম, কুড়িগ্রামের মো. আবদুস সবুর ফারুকি, মো. নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী বিউটি বেগম।
নাম রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মো. মঞ্জুরুল আহসান খান, নেত্রকোনার মো. কামরুজ্জামান ও গোপালগঞ্জের খান ইবনে আসিফের।
আর নাম রয়েছে- সংসদ ভবনের অভ্যর্থনাকারী মো. সাজ্জাদ হোসেন, কমিটি শাখা-৮ এর মো. জজ মিয়া, রংপুরের হাফেজ মো. রফিকুল ইসলাম ফারাজী, টাঙ্গাইলের মো. মোন্তাজ আলী, টাঙ্গাইলের কে এম ইমদাদুল আলম (শামিম), গোপালগঞ্জের মো. আ. মান্নান খাঁন ও তার স্ত্রী মাকসুদা আক্তার, গোপালগঞ্জের হাবিবুর রহমান, রংপুরের মো. জয়নাল আবেদীন প্রধান, ঢাকা মিরপুরের মো. আ. মালেক, গাইবান্ধার মো. তোফাজ্জল হোসেন, জয়পুরহাটের মোছা. মাহফুজা বেগম, নাটোরের মো. মারুফ হোসেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আসলাম উদ্দিন, প্রেস উইংয়ের মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, অফিস সহায়ক পারুল পারভীন, ব্যক্তিগত সহকারী মো. আজহারুল হক, সহকারী সচিব মীর এমদাদ হোসেন, সহকারী সচিব মোসা. আমেনা খানম, গাড়িচালক মো. আবুল কালাম, গাড়িচালক মোছা. মমতাজ বেগম, উচ্চমান সহকারী মোসা. ছালমা বেগম, ওয়ার্ক চার্জড লাইনম্যান মো. মাইনুদ্দিন, সহকারী সাইন অপারেটর মো. মিজানুর রহমান, ওয়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. আবুল কাশেম, পাওয়ার মেশিন অপারেটর আবু তাহের, সহকারী সচিব মো. মোতাহের হোসেন ও তার স্ত্রী মোসা. হাফেজা আক্তার, পুলিশ পরিদর্শক মো. লুৎফুর রহমান, বার্তাবাহক ফখরুদ্দিন আহমেদ, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর খন্দকার আজিজুর রহমান ও মো. সাজিদুর রহমান, পরিছন্নতা কর্মী গোলাপ মিয়া, মো. আব্দুল মান্নান, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর উচ্চমান সহকারী মো. মিজানুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গাড়িচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন ও তার স্ত্রী রওশন আরা বেগম, মুন্সিগঞ্জের এ কে এম মজিবুর রহমান, ধানমন্ডির অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মো. জাকির হোসেন, সর্বপ্রাপ্ত সচিব মো. কুদ্দুস খান, নাটোরের বর্ষিয়ান নেতা মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ মোল্লার দুই সন্তান সুলতানা পান্না ও মো. মেহেদী হাসান, কুমিল্লার মো. মকবুল হোসেন, জামালপুরের ফারুক আহমেদ, বরগুনার মো. আব্দুল আলীম (বাবুল), ময়মনসিংহের মো. রফিকুল ইসলাম, পটুয়াখালীর মো. আব্দুস সাত্তার আকন, খুলনার বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিদ্দিকুর রহমান।
২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করেন মাত্র ২৩ জন
প্রতিবছরই কয়েক শ মানুষকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ পালনের জন্য পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় ২০২২ সালে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২৫৪ জনকে হজে পাঠানো হয়েছিল।
২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ পালনের জন্য পাঁচ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। আবেদনকারীদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব ও তাদের গানম্যান, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নাম থাকায় এটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় খরচে পছন্দের লোক পাঠাতে কোটা দাবি করেছিলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সদস্যরা। তাদের বেশির ভাগ সদস্যই নিজ সুপারিশে অন্তত দুজন করে হজে পাঠানোর সুযোগ চেয়েছিলেন। ফলে সরকারি টাকায় হজে যেতে আবেদনকারীদের নানামুখী চাপ, সমালোচনা ও তদবিরে জেরবার হয়ে উঠেন ধর্ম মন্ত্রণালয়। পরে হজের খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাওয়ার লাগাম টানে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো তালিকা অনুযায়ী মাত্র ২৩ জন রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যান। তবে, তাদের বিমান ভাড়া বাবদ এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়।
আইনে কী আছে?
রাষ্ট্রীয় খরচে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়টি বিদ্যমান হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনা বিধিমালাতেই আছে। বিধিমালার ২৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার প্রয়োজনীয়সংখ্যক অসচ্ছল ব্যক্তিকে হজ করিবার উদ্দেশ্যে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করিতে পারিবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার এই সহযোগিতার পরিমাণ নির্ধারণ করিতে পারিবে।’ এর ভিত্তিতেই প্রতিবছরই কয়েক শ মানুষ রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাচ্ছেন। কয়েক দশক ধরেই এই চর্চা চলে আসছে।
হজ ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় অসচ্ছল মুসলমানদের এই সুযোগ দেওয়ার বিধান থাকলেও অসচ্ছলরা সুযোগ পান খুবই কম। মূলত সরকারের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, মসজিদের ইমামসহ কিছু মানুষ প্রতিবছর সরকারি খরচে হজে যান।
সরকারি খরচে হজের বিধান
কেউ রাষ্ট্রীয় খরচে হজ পালন করলে তার হজ আদায় হবে বলে অভিমত দিয়েছেন ইসলামি স্কলাররা। উত্তরা বাইতুল মামুর জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবুল হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, রাষ্ট্রীয় খরচে কেউ হজ করলে তার ফরজিয়ত আদায় হয়ে যাবে। কেননা হজের জন্য সক্ষমতা শর্ত। আর হজের যাবতীয় খরচ সরকারের পক্ষ থেকে তার নামে বরাদ্দ করা হয়। আর তখন তিনি সেই সম্পদের মালিক হয়ে যান। অবশ্য সক্ষম মুসলিম ব্যক্তির জন্য নিজের উপার্জিত পবিত্র সম্পদ দ্বারা হজ করাই উত্তম বলে তিনি মত দেন।