হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের কিছু লোক সম্পর্কে জানি; যারা কেয়ামতের দিন তিহামা পাহাড় পরিমাণ শুভ্র নেক আমল নিয়ে হাজির হবে। (অর্থাৎ হয়ত তাদের জীবনে নফল আছে। তাবলিগ আছে। তালিম আছে। দ্বীনের বহুমুখী খেদমত আছে।) কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাদের এত বিশাল বিশাল আমলকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে একেবারে লাপাত্তা করে দেবেন।
হাদিসটির বর্ণনাকারী হজরত সাওবান (রা.) এটা শুনে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, তারা তোমাদেরই ভাই এবং তোমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত। তোমাদের যেমন রাত আসে তাদের কাছেও রাত আসে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, নির্জনে নিভৃতে আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয়। -ইবনে মাজাহ : ৪২৪৫
গোনাহ থেকে বিরত থাকার জন্য এই হাদিসে রয়েছে শিক্ষা। আমাদের উচিৎ হাদিসের বিষয়বস্তু মনে রাখা। মনে রাখা, গোপন গোনাহ আমার আমল নষ্ট করে দিচ্ছে না তো? আমার তাবলিগ, আমার জিহাদ, আমার হজ, আমার ইতেকাফ, আমার সদকা অজগরের মত গিলে ফেলছে না তো? এভাবে চিন্তা ধরে রাখতে পারলে ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে সহজে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে এ বিষয়গুলো মনে রাখা-
সব আমল আল্লাহর সামনে পেশ করা হবে
গুনাহের প্রবল ইচ্ছা দমনে উক্ত চিন্তা বেশ কাজে আসে। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সেদিনের ভয় করো, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’ -সূরা বাকারা : ২৮১
অন্যত্র আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘সেদিন উপস্থিত করা হবে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কোনো গোপনই আর গোপন থাকবে না।’ -সূরা আল হাক্কাহ : ১৮
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) একদিন বাগদাদের বাজারে এলেন। অতঃপর এক বোঝা কাঠ খরিদ করে কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করলেন। অতঃপর যখন লোকেরা তাকে চিনে ফেলল, তখন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে, দোকানদাররা দোকান ছেড়ে, পথিকরা পথ চলা বন্ধ করে তার কাছে ছুটে এলো ও সালাম দিয়ে বলতে লাগল, আমরা আপনার বোঝা বহন করব। তখন তার হাত কেঁপে উঠল, চেহারা লাল হয়ে গেল, দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অতঃপর তিনি বারবার বলতে থাকলেন, আমরা মিসকিন। যদি আল্লাহ আমাদের পাপ ঢেকে না দেন, আমরা অবশ্যই সেদিন লাঞ্ছিত হবো। -হুলইয়াতুল আউলিয়া : ১/১৮১
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে
যেকোনো গুনাহর করার আগে স্মরণ করুন, যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ব্যবহার করে আপনি গুনাহ করছেন, সেগুলো কেয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে আপনারই বিরুদ্ধে। এ জগতে নয়, বরং ওই জগতে সবার সামনে আপনাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে সীলমোহর লাগিয়ে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে, আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে।’ -সূরা ইয়াসিন : ৬৫
শুধু কি তাই! আমার শরীরের চামড়াও সাক্ষী দিবে আমার বিরুদ্ধে, যদি আমি তা আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করি। সে দিন মানুষ নিজের শরীরের চামড়াকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন? সেগুলো উত্তর দেবে, ‘আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে।’ -সূরা হামিম আসসাজদা : ২১
আমলগুলো লিপিবদ্ধ হচ্ছে
স্মরণ করুন, আপনার কথা ও কাজের প্রতিটি অংশ লিপিবদ্ধ করে নিচ্ছে দায়িত্ব পালনকারী ফেরেশতারা। তাদের কাছে আপনার কোনো কিছুই গোপন নয়। আপনার মরণ পর্যন্ত তারা আপনার পেছনে লেগে আছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের ওপর নিযুক্ত আছে তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লেখকগণ (যারা লিপিবদ্ধ করছে তোমাদের কার্যকলাপ), তারা জানে তোমরা যা করো।’ -সূরা ইনফিতার : ১০-১২
পুলসিরাত পাড়ি দেওয়ার কথা স্মরণ করা
সবাইকেই পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতের দিকে যেতে হবে। পুলসিরাত মানে জাহান্নামের ওপর স্থাপিত সেতু। যা তলোয়ারের চেয়ে ধারালো হবে এবং চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম হবে। কাফের ও পাপাচারীরা সেখানে পদস্খলিত হয়ে নিচে পতিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের প্রত্যেককেই তা অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমার রবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ -সূরা মারইয়াম : ৭১
আল্লামা কাসত্বালানি (রহ.) বলেন, ভেবে দেখুন, যখন আপনি পুলসিরাতের ওপর উঠবেন এবং সেখান থেকে নীচের জাহান্নামের দিকে দৃষ্টি দেবেন। অতঃপর জ্বলন্ত আগুনের গর্জন, জাহান্নামের নিঃশ্বাস ও কৃষ্ণতা আপনার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হতে থাকবে, তখন আপনার অবস্থা কেমন হবে? যদি আপনার কোনো পা পিছলে যায়, তবে আপনি এর প্রখরতা টের পাবেন এবং দ্বিতীয় পা ওপরে ধরে রাখার কসরত করবেন। আপনার সামনেই অন্যরা পিছলে পড়ে যাবে এবং আগুনের তাপ অনুভব করবে। জাহান্নামের ফেরেশতারা তাদেরকে পাকড়াও করতে থাকবে, যারা পুলসিরাতের উল্টো কাঁটাযুক্ত আংটা ও আঁককড়াতে বিদ্ধ হবে। আপনি সেটা দেখতে থাকবেন। তখন সেই দৃশ্যটা কত বিভীষিকাময় হবে? আরোহণের পথটা কতই না ভয়ঙ্কর হবে এবং অতিক্রমটাও কতই না সঙ্কীর্ণতর হবে? আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই, সাহায্য চাই এবং অনুগ্রহ কামনা করি। -ইরশাদুস সারি : ৯/৩৩০