হজের ইহরাম: দুই খণ্ড সাদা কাপড় যখন হজযাত্রীর সঙ্গী

, ইসলাম

ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 18:37:41

হজের সফরের নির্দিষ্ট দিন নিশ্চিত হয়ে বাড়ী থেকে বের হতে হবে। রওয়ানা দেওয়ার আগে মা-বাবা ও মুইব্বদের বলে, তাদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বের হবেন। গণহারে সবাইকে বলার প্রয়োজন নেই।

অনেকে মসজিদে মসজিদে বলে বেড়ায়। এতে যদি লোক দেখানোর মানসিকতা না থাকে তাহলে তা জায়েজ। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশি বলে বেড়ানোর পক্ষে না। অনেকে হজে যাওয়ার পূর্বে গরু জবাই করে গ্রামের লোকদের খাওয়ায়, আত্মীয়-স্বজনদের জমায়েত করে বিদায় অনুষ্ঠান করে। এগুলোতে লোক দেখানোর মনোভাব চলে আসার সম্ভাবনা আছে বলে এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া আমি ভালো মনে করি। তবে বিদায়ের মুহূর্তে কোনো আত্মীয় চলে এলে, এতে ক্ষতি নেই। বাড়ী থেকে বিদায় হয়ে ঢাকায় হাজী ক্যাম্পে বা কাফেলার পক্ষ থেকে যেখানে উপস্থিত হতে বলা হবে সেখানে অথবা বিমানবন্দরে পৌঁছে যেতে হবে।

হজ বা উমরার জন্য নিয়ত করা যাকে ইহরাম বলা হয়ে থাকে তা আপনাকে করে নিতে হবে নির্দিষ্ট মিকাতের পূর্বেই। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার ক্ষেত্রে উড়োজাহাজে থাকা অবস্থায় মিকাত পড়বে। জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছার প্রায় এক ঘন্টা পূর্বে এ মিকাত অতিক্রম করা হয়। এর পূর্বে ইহরাম বাঁধতে হবে। তবে বিমানে উঠার পূর্বে বাসায় বা বিমানবন্দরে ইহরাম বেঁধে নিলে ভালো। সে ক্ষেত্রে ধীরে সুস্থে সুন্দর পরিবেশে ইহরাম বাঁধা যায়।

ইহরামের গুরুত্ব
ইহরাম আরবি শব্দ; ইহরামের আভিধানিক অর্থ- হারাম বা নিষিদ্ধ করা। ইসলামি পরিভাষায় ইহরাম হলো- হজ বা উমরা সম্পাদনের নিয়ত করা। ইহরাম হজের তিন ফরজের প্রথম ফরজ এবং উমরা এর দুই ফরজের প্রথম ফরজ। ইহরাম অবস্থায় মানুষ এমন একটি অবস্থায় অবস্থান করেন- যা প্রকৃত মুমিনে কামিলের মাকাম। তা-ই স্রষ্টার কাম্য এবং অলি আল্লাহদের আরাধ্য। ইহরাম হলো- সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ। ইহরাম অবস্থায় নিজেকে যেভাবে হালাল বস্তু ও কর্ম থেকে বিরত ও নিবৃত রাখা হয়েছে; ইহরামের বাইরে হারাম বস্তু ও বিষয় থেকে নিজেকে সেভাবে মুক্ত ও পবিত্র রাখাই হলো- ইহরামের মূল শিক্ষা ও দর্শন।

ইহরাম বাঁধা
আপনি যদি কেরান হজ করেন তাহলে হজ ও উমরার জন্য ইহরাম বাঁধতে হবে। যদি ইফরাদ হজ করেন তাহলে শুধু হজের জন্য ইহরাম বাঁধতে হবে। যদি তামাত্তু হজ করেন তাহলে শুধু উমরার জন্য ইহরাম বাঁধতে হবে। সব ইহরাম বাঁধার নিয়ম একই শুধু নিয়ত যা মনে মনে বা মুখে উচ্চারণ করা হয় সে সময় নির্দিষ্ট করতে হবে আপনি মূলতঃ কী করতে চাচ্ছেন?

ইহরাম বাঁধার পূর্বে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিবেন। কারণ ইহরাম বাঁধার পর নখকাটা, চুলকাটা, অন্যান্য বিশেষ স্থান পরিস্কার করার অনুমতি নেই। তাই এ গুলো সেরে নিয়ে গোসল করে পুরুষরা সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করে নিবেন। দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেওয়া সুন্নত। নামাজ পড়া শেষ করে পুরুষরা মাথায় ও পায়ে কিছু থাকলে তা সরিয়ে নিবেন এবং ইহরাম বাঁধার নিয়ত করবেন। নিয়ত করা মনের সিদ্ধান্তের বিষয়। মুখে উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। মুখে উচ্চারণ করতে চাইলে নিষেধ নেই। যে কোনোভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেই হলো। নিয়ত এভাবে বলা যেতে পারে-

শুধু উমরার ক্ষেত্রে (তামাত্তুর ক্ষেত্রে)

اَللّهُمَّ اِنِّى اُرِيْدُ الْعُمْرَةَ َ فَيَسِّرْهَا لِىْ وَ تَقَبَّلْهَا مِنِّىْ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ইয়াসসিরহা লী ওয়াতাকাব্বালহা মিন্নী।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি উমরার নিয়ত করছি। তা আমার জন্য সহজ করে দাও, আর তা কবুল করো।

শুধু হজের ক্ষেত্রে (ইফরাদ হজ বা তামাত্তুর ক্ষেত্রে)

اَللّهُمَّ اِنِّى اُرِيْدُ الْحَجَّ فَيَسِّرْهُ لِىْ وَ تَقَبَّلْهُ مِنِّىْ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা, ইয়াসসিরহু লী ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নী।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি হজের ইচ্ছা পোষণ করেছি। তা আমার জন্য সহজ করো এবং তা আমার পক্ষ থেকে কবুল করো।

হজ ও উমরা একসঙ্গে হলে (কিরান হজের ক্ষেত্রে)

اَللّهُمَّ اِنِّى اُرِيْدُ الْحَجَّ و الْعُمْرَةَ َ فَيَسِّرْهُمَا لِىْ وَ تَقَبَّلْهُمَا مِنِّىْ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ওয়াল উমরাতা, ইয়াসসিরহুমা লী ওয়া তাকাব্বালহুমা মিন্নী।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি হজ ও উমরা পালন করতে চাচ্ছি। উভয়টি আমার জন্য সহজ করে দাও এবং কবুল করে নাও।

আবার বলছি, নিয়ত মুখে বলার প্রয়োজন নেই। মনে মনে হজ ও উমরার সিদ্ধান্ত নিলেই নিয়ত হয়ে গেল। নিয়তের পরে তালবিয়া বলবেন। তালবিয়ার সুন্নত বাক্য হলো-

উচ্চারণ: ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বিইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।’

অর্থ: হাজির হে আল্লাহ! আমি হাজির। হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, হাজির আমি। নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামতরাজি ও রাজত্ব তোমারই। তোমার সঙ্গে শরীক নেই কেউ।

মাসয়ালা: দুই রাকাত নামাজ পড়ে ইহরামের নিয়ত করার পর পুরুষরা মাথায় টুপি, পাগড়ী বা অন্যকোনো কাপড় থাকলে তা সরিয়ে নিয়ে তালবিয়া পাঠ শুরু করবে। তালবিয়া পাঠের মাধ্যমেই ইহরাম শুরু হয়। তালবিয়া যখন বলা হবে তখন পরপর তিনবার বলা ভালো। এর চেয়ে বেশিও বলা যাবে। বরং অন্য নফল আমলের তুলনায় তালবিয়া বেশি বলা ভালো। বিশেষতঃ কোনো কাজ শুরু করা বা শেষ করার সময় তালবিয়া বলা মুস্তাহাব। যেমন, সকালে ঘুম থেকে উঠে, বাইরে যাওয়ার সময়, ঘরে প্রবেশ করার সময়, গাড়িতে উঠার সময়, কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে, কারও থেকে বিদায় নেওয়ার সময়, ওপরে উঠার সময়, নীচে নামার সময় মোটকথা উঠা-বসা অবস্থায় তালবিয়া পড়তে থাকা। তালবিয়া বলার পর দোয়া করতে চাইলে দোয়া করা যেতে পারে।

মাসয়ালা: ইহরাম শুরু করার পর থেকে তালবিয়া পড়া শুরু করতে হবে। এ তালবিয়া কাবা ঘরে পৌঁছে তাওয়াফ শুরু করা পর্যন্ত বার বার সুযোগ মতো পড়তে হবে। তাওয়াফ শুরুর পর আর তালবিয়া পড়তে হবে না।

মাসয়ালা: ৮ জিলহজ যখন আবার হজের ইহরাম বাঁধা হবে তখন আবার তালবিয়া পড়া শুরু হবে। মক্কায়, মিনায়, আরাফায়, মুজদালিফায় চলবে তালবিয়া পাঠ। ১০ জিলহজ মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারার পর তালবিয়া পাঠ শেষ হবে।

ইহরামের সময় সতর্কতা
ইহরাম মানে হারাম করে নেওয়া। অন্য সময়ে অনেক কিছু জায়েজ হলেও ইহরাম শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্নোক্ত কাজ করা নাজায়েজ।

১. পুরুষদের জন্য শরীরের মাপে সেলাই করা বা বুনন করা কাপড় যেমন শার্ট, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, পায়জামা, শেরওয়ানি, কোট, সোয়েটার, মোজা, জাঙ্গিয়া ইত্যাদি পরিধান করা নিষেধ।

২. টাকা-পয়সার থলে বা বেল্ট পরিধান করা যাবে।
৩. কাপড়ে বা শরীরে কোনো প্রকার সুগন্ধি মাখতে পারবে না। সুগন্ধিযুক্ত সাবানও ব্যবহার করা যাবে না। ফল-ফুলের সুঘ্রাণ ইচ্ছা করে গ্রহণ করা মাকরূহ। তবে যে কোনো সুগন্ধি যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে নাকে ঢুকে পড়ে তাতে সমস্যা নেই।

৪. শরীর থেকে কোনো লোম বা চুল উঠানো বা কাটা নিষেধ।
৫. নখ কাটা নিষেধ।
৬. পুরুষদের মাথা বা মুখ ঢাকা নিষেধ। মহিলাদের মুখের ওপর কাপড় রাখা নিষেধ।

৭. ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী মিলন বা আনুষাঙ্গিক কাজ করা সম্পূর্ণরূপে না জায়েজ। এমনকি নারীদের সামনে এ সংক্রান্ত কথা বলাও নাজায়েজ।

৮. স্থলভাগের কোনো প্রাণী হত্যা বা শিকার করা নিষেধ। এমনকি নিজে শিকার না করে অন্য কাউকে শিকার করতে ইশারা করাও নিষেধ।
৯. ঝগড়া-বিবাদ করা নিষেধ।
১০. গায়ে বা কাপড়ে লেগে থাকা উকুন সরানোও নিষেধ।
১১. টিড্ডি মারাও নাজায়েজ।

লেখক: অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হজ বিষয়ে জানতে আরও পড়ুন

** হজ: আল্লাহপ্রেমিকদের মিলনমেলা

** হিসাব রক্ষক ও ফিল্ড সুপারভাইজার এখন সরকারি হজগাইড!

** শ্রেষ্ঠ আমল হজ, বিনিময়ে জান্নাত

** নারীদের ওপর কখন হজ ফরজ?

** যেসব পদ্ধতিতে হজ আদায় করা যায়

** বদলি হজের লোক বাছাইয়ে সর্তক থাকুন

** পবিত্র হজ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে

** জেনে নিন হজে উচ্চারিত কিছু আরবি পরিভাষার অর্থ

** ৫১ সদস্যের হজ প্রশাসনিক দল গঠন

** আল্লাহর ঘর কাবা শরীফের আদবসমূহ

** হজে কোনো কোরবানি নেই, আছে দমে শোকর

** হজ আদায়ে তিন কাজ, অনাদায়ে হজ হবে না

এ সম্পর্কিত আরও খবর